শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গঠন করা হয়েছে কয়েকটি কমিশনও। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান করা হয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারকে। আমাদের সময়ের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে বদিউল আলম মজুমদার জানিয়েছেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে তার ভাবনার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের সময়ের কূটনৈতিক প্রতিবেদক- আরিফুজ্জামান মামুন

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছেন। এটিকে কীভাবে দেখছেন?

বদিউল আলম : অবশ্যই সম্মানিত বোধ করছি। এটাকে অপূর্ব সুযোগ বলে মনে করছি। এর মাধ্যমে যে বিষয়গুলো নিয়ে বহুদিন ধরে কথা বলছি, সেগুলো নিয়ে সুপারিশ তুলে ধরতে পারব; যেন সরকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে। এতে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ সুগম হবে।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুথানের পর রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে, এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?

বদিউল আলম : আমাদের সংবিধান এবং আইন-কানুন কর্তৃত্ববাদী সৈরাচার ব্যবস্থার সহায়ক হয়েছে। আইন থাকলেও না মানার অভ্যাস বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি করেছে। এগুলো যেন পরিবর্তন হয়, সে জন্যই রাষ্ট্র সংস্কারের আলোচনা। এই যে তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করা হলো এতে কী হলো, যারা ক্ষমতায় ছিল তাদের অধীনে নির্বাচন হলো। সেখানে পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য।

দেশের সংকট উত্তরণে রাজনৈতিক সংস্কারে কোন কোন ক্ষেত্রে জরুরি মনে করেন?

বদিউল আলম : এই যে আমাদের সবকিছু ভেঙে পড়েছে। পুলিশ, প্রশাসন, রাজনীতিক অনেকেই পালিয়ে গেছে। আপিল বিভাগের

সবাই পদত্যাগ করেছেন একজন ছাড়া। দলীয়করণ, আইনের শাসন, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এখানে জরুরি। একটি সংস্কার তো ব্যপক আলোচিত যে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে কিনা। এমন অনেক প্রস্তাব আছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আলোচনায় রয়েছে। আমি স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়ার বিপক্ষে। তবে আমরা সবার সঙ্গে কথা বলব। সবার মতামত নিয়ে তার ভিত্তিতে সুপারিশ করব।

নির্বাচনী ব্যবস্থায় কী ধরনের সংস্কার আনতে চান?

বদিউল আলম : যে নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয় না, সেই নির্বাচন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বড় বাধা নির্বাচনে যারা অংশীজন তারা সঠিক ভূমিকা পালন করে না। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কথা বলা হয়েছে এবং তাদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা হয়েছে; যেন তাদের পদচ্যুতি না করতে পারে। ২০২২ সালে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে একটি আইন প্রণয়ন হয়েছে, যা অগ্রহণযোগ্য। এই আইনের ফলেই সরকারের যারা অনুগত তারা কমিশনে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এই আইনের মধ্যে একটি বিধান আছে- সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের; কিন্তু বর্তমান বিধানের আওতায় কয়েকটি সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা এই অনুসন্ধান কমিটির সদস্য হন। এসব ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয় তারা যেন সরকারের প্রতি অনুগত থাকে। বিধানে আছে- অন্তত দুজন ব্যক্তিকে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেওয়ার। আর সরকারের পক্ষ থেকে তাদের অনুগতদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়। গত তিনটি কমিশন এভাবেই গঠন করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, এমন একটি আইনের খসড়া করব; যেটি হবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে। এটা হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি থাকবে, বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি থাকবে, তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধি থাকবে; প্রতিনিধি থাকবে গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের। এর মাধ্যমে আমরা একটি ভালো নির্বাচন কমিশন পাব।

নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। কীভাবে এটিকে সংস্কারের চিন্তা করছেন?

বদিউল আলম : নির্বাচন কমিশন আইনটি ত্রুটিপূর্ণ। কারণ এই আইনের মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া যায়। যেমন- আইনের বিধান অনুযায়ী একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করতে হবে। সেই কমিটিতে যারা থাকবে তাদের মধ্যে কয়েকজন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং কয়েকজন বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং দুজন সরকারের সুপারিশকৃত ব্যক্তিদের নিয়ে হবে। এই যে প্রতিষ্ঠানগুলো; এখানে তো সরকারের অনুগতরাই থাকে। এর অর্থ হলো- চাইলে যে কোনো ব্যক্তিকেই নিয়োগ দিতে পারবে এবং সেটাই করা হয়েছে। আর আউয়াল কমিশনের নিয়োগ নিয়ে আরও বড় প্রশ্ন রয়েছে। আইনের ব্যতয় ঘটিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আইনে আছে- শুধু রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠন নাম প্রস্তাব করতে পারবে; কিন্তু প্রধান বিচারপতি এসে এটা উন্মুক্ত করে দিলেন। অর্থাৎ ব্যক্তি নিজের নাম নিজে প্রস্তাব করতে পারবে, যেটি আইনের ব্যতয়।

নির্বাচনে অধিকাংশ দল ইভিএমের বিপক্ষে, এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

বদিউল আলম : ইভিএম নিয়ে অনেক অভিযোগ। এই ইভিএম অত্যন্ত দুর্বল, কোনো পেপার ট্রায়াল ছিল না। এটা কেন হয়েছে, সেটি প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী; যিনি কারিগরি উপদেষ্টা ছিলেন তার সুপারিশ অমান্য করা হয়েছে। এখানে অনেক বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া। যদি ঐকমত্য সৃষ্টি হয় তা হলে টেকনোলোজি ব্যবহারের কথা ভাবা হবে। তবে এই ইভিএম কোনোভাবেই নয়।

অতীতের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনার দায় নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ইমেজ সংকট কীভাবে কাটবে?

বদিউল আলম : ২০০৭ সালে হুদা কমিশন গঠনের আগে এবং পরে নির্বাচন কমিশনে কিছু কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কথা হচ্ছে- এরাই নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাদের মধ্য থেকে যদি সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল থেকে সচিব নিয়োগ দেওয়া হলে এ সমস্যা দূরীভূত হবে। সচিব পদমর্যদার বা উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিরা যদি সরকারের পছন্দের লোক না হন তা হলে সংকটের নিরসন হবে। আগামী নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হবে, তাই এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। আগামী নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হলে পরে সরকার যারা গঠন করবে তখন নিয়োগকৃত সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সচিব নেওয়া সম্ভব হবে।

অতীতে প্রহসনের নির্বাচনে জড়িত থাকা মাঠ প্রশাসন সংস্কারের বিষয়ে কী ভাবছেন?

বদিউল আলম : নির্বাচনে অনেক অংশীজন থাকে। প্রথম অংশীজন নির্বাচন কমিশন। এর পর অংশীজন সরকার; সরকার বলতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন। তারা যদি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ না করে তা হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। তবে এক্ষেত্রে বড় বাধা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। দলীয়করণ দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এটা বিএনপির আমলেও হয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে বলেছিল, তারা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনবে। সেটি তারা করেনি। বরং এর ভয়াবহতা বেড়েছে। আমাদের সুপারিশ থাকবে এই সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার।

সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তির সদিচ্ছা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?

বদিউল আলম : এখানে ব্যক্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানও গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি সহযোগিতা না করে, বিশেষ করে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি অসদাচরণ করে; পক্ষপাতদুষ্ট থাকে এবং গণমাধ্যম যদি একতরফা প্রচার চালায়, নাগরিক সমাজ নজরদারির ভূমিকা পালন করতে না পারে- তা হলে মেরুদ-সম্পন্ন নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। যে নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক নয়, সেই নির্বাচন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর জন্য সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচন করা; কিন্তু আমি বলব- তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তারা শপথ নিয়েছেন সংবিধান রক্ষার। অথচ তারা সংবিধানকে পদদলিত করেছেন।

আওয়ামী লীগ অংশ না নিলে নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হবে না- আপনার এমন একটি বক্তব্য আলোচনায় এসেছে। এতে কি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে?

বদিউল আলম : নির্বাচন মানেই প্রতিযোগিতা। নির্বাচনে বিকল্প থাকতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প। প্রশ্নটি ছিল হাইপোথ্যাটিক্যাল। উত্তরটি খ-িতভাবে প্রচার হয়েছে। বক্তব্যটি ছিল, আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। এই নির্বাচনে সরকার কাউকে বাধা দেবে না। বর্তমানে আওয়ামী লীগের অনেকেই পলাতক, অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। তারা যদি সংগঠিত হতে না পারে এবং নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে তা হলে তো নির্বাচন আটকে রাখা যাবে না। আমার আশা, সবার অংশগ্রহণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।

তিন মাসের মধ্যে কি কমিশনের প্রস্তাব পেশ করা সম্ভব হবে?

বদিউল আলম : সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব সংস্কার সম্ভব হবে না। সবগুলো দিক হয়তো আমরা গভীরভাবে পর্যালোচনার সময়ও পাব না। আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করব, যেন এই তিন মাসের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য সুপারিশমালা পেশ করতে পারি।

তথ্য সূত্র: আমাদের সময়  |  ১৪ অক্টোবর, ২০২৪