ভোটাধিকার, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রশ্নে দুই দশকের বেশি সময় ধরে সোচ্চার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে যে ৬টি কমিশন গঠন করেছে, সেখানে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। সম্প্রতি সময়ের আলোকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এই কমিশনের কর্মপরিধি এবং নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার কার্যক্রমের গতি-প্রকৃতি ও সংকট-সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তার মতে, টেকসই সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা অপরিহার্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সহ-সম্পাদক মো. অলিউল ইসলাম
সময়ের আলো : নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধানের দায়িত্ব পাওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন। এই দায়িত্বকে কীভাবে দেখছেন? এই কমিশনের কর্মপরিধি কী হবে?
বদিউল আলম মজুমদার : দায়িত্ব পাওয়াটাকে আমি সম্মানের বিষয় মনে করি। একই সঙ্গে অপূর্ব সুযোগও। আমাদের দীর্ঘদিনের কাজের প্রতি আস্থাশীল হয়েই অন্তর্বর্তী সরকার এই দায়িত্ব দিয়েছে। কেবল আমি নই, আমার বহু সহকর্মী, আমরা একসঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে সোচ্চার ছিলাম। আমাদের সবার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই আমি সত্যিই গর্ববোধ করছি।আর এখনও কমিশনের কর্মপরিধি নির্ধারণ হয়নি। কারণ এখনও এ সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে আমরা যতটুকু জেনেছি, কমিশনের সময়সীমা তিন মাস। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই আমরা আমাদের সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ হাজির করব। পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠনের পর সরকারের দেওয়া টার্মস অব রেফারেন্সের ভিত্তিতে আমাদের কাজ শুরু হবে। সব ক্ষেত্রে সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়ার পর আশা করি সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হবে।
সময়ের আলো : সংস্কার কমিশনে কাদেরকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবেন?
বদিউল আলম মজুমদার : কাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সংস্কার করব, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারা এই কমিশনের সদস্য হবে, তা নির্ধারণ করা হবে প্রধান উপদেষ্টাসহ অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে। এখনও কোনো কিছুই আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত হয়নি। আশা করি শিগগিরই আমরা একটি টিম আকারে কাজ শুরু করব। আপনারা জানতে পারবেন।
সময়ের আলো : সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
বদিউল আলম মজুমদার : অনেক ক্ষেত্রেই সংস্কার দরকার। ২০২২ সালে আমাদের যেই নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন হয়েছিল, এটি কোনো আইন নয়। আগে যে প্রজ্ঞাপন ছিল, এই প্রজ্ঞাপনটাকে আইন হিসেবে পার্লামেন্টে পাস করা হয়েছে। শুধু একটা জিনিস যুক্ত করেছে, একটা দায়মুক্তির বিধান যোগ করেছে। এই আইনটি সংশোধন করতে হবে। আমাদের অনেক নির্বাচনি আইন আছে; যেমন-গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। ভোটার তালিকা তৈরির আইন আছে, সীমানা প্রতিনির্ধারণের আইন আছে-এ রকম অনেক আইন আছে। এই আইনগুলোও সঠিক ও কার্যকর হতে হবে। আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সঠিক হতে হবে। তবে আরপিওটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য, অন্যান্য আইনও। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ আইনটি সঠিক নয়। এই আইনগুলো সংস্কার করে তার আলোকে নিয়োগ দিতে হবে। যেমন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের ভিত্তিতে সঠিক ব্যক্তিদের স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে, যাতে তারা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হন। কোনো দলের প্রতি তাদের আনুগত্য যেন না থাকে।এর বাইরে হলফনামার ছকের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। হলফনামা যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। নির্বাচনি ব্যয় যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। এই কার্যক্রমগুলোই হবে আমাদের সংস্কার প্রস্তাবের অন্যতম অগ্রাধিকার। পাশাপাশি লেজুড়বৃত্তির ছাত্র সংগঠন বাদ দেওয়ার কথা ছাত্রদের ৯ দফার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ছাত্র সংগঠনসহ রাজনৈতিক দলগুলোর এমন অনেক অঙ্গ সংগঠন আছে। এগুলো বাদ দেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া সম্প্রতি শীর্ষ এক জাতীয় দৈনিকের জরিপে দেখেছি, ৯৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি চান না। জরিপটিতে অংশগ্রহণকারী ছিল ৩ লাখেরও বেশি। তাই আমি আশা করি এটিও আমাদের সংস্কার প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত হবে।
সময়ের আলো : ক্ষমতায় গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এই সংস্কার মানবে কী?
বদিউল আলম মজুমদার : সংস্কার কাজে রাজনৈতিক সমঝোতা লাগবে। এটি না হলে সংস্কার টেকসই হবে না। আমাদের রাজনীতিবিদদেরই সংস্কারের মালিকানা দিতে হবে। একই সঙ্গে তাদেরও সংস্কার প্রস্তাব করতে হবে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে তারা যখন যে ক্ষমতায় যাবে, এগুলো বাস্তবায়ন করবে। এ জন্য সংস্কারের বিষয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোরও মতামত চাচ্ছি। আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নিশ্চয়ই এ উপলব্ধি আসছে। আমাদের সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সব প্রস্তাব জমা দেবে সরকারের কাছে। তবে আমাদের সুপারিশ আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি না সেটি নির্ভর করবে এটির স্বপক্ষে আমরা কতটা রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে পারি তার ওপর।
সময়ের আলো :অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে নির্বাচনকালীন আমাদের কোন ধরনের সরকার থাকা উচিত বলে মনে করেন?
বদিউল আলম মজুমদার : এটি এই কমিশনের কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে না। এর এখতিয়ার মূলত সংবিধান সংস্কার কমিশনের। তবে আমাদেরও বলার থাকবে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো মোটামুটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলসহ ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় যদি আমাদের পক্ষে আসে, তা হলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি হবে। সেই পাটাতনে দাঁড়িয়ে এই ব্যবস্থায় সংযোজন-বিয়োজন এনে আমরা আধুনিক নির্বাচনি ব্যবস্থার দিকে যেতে পারব।
সময়ের আলো :একটু আগে আপনি নির্বাচনি জনবল নিয়ে বলছিলেন। প্রতি জেলায় নির্বাচনি কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও প্রধান দায়িত্ব পালন করেন ডিসি-ইউএনওরা। আপনি আগেও এ নিয়ে বহুবার বলেছেন। সংস্কার উদ্যোগে কি বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে?
বদিউল আলম মজুমদার : বস্তুত ২০০৭-০৮ কিংবা তারও আগে বহু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল যেন কমিশন নিজস্ব জনবলে নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত এই জনবলকেও রাজনৈতিক হাতিয়ার করা হয়েছে। তাদের প্রশাসনের হস্তক্ষেপে দলীয় কর্মীতে পরিণত করা হয়েছে। সে কারণেই মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাই যদি নির্বাচনের গুরুদায়িত্ব পালন করে সেটিই সবথেকে কাংখিত।
সময়ের আলো : ইসি সচিব নিয়োগের বিধানে কি পরির্তন আসবে?
বদিউল আলম মজুমদার : সরকার তাদের অনুগতদের নির্বাচন কমিশনে বসিয়ে নির্বাচনি ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। এর অবসান হওয়া দরকার। আমি আগেই বলেছি, স্বাধীনভাবে কাজ করতে হলে ইসির নিজস্ব লোকবল বাড়াতে হবে। সরকার স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে যেন তাদের প্রভাবিত করতে না পারে।
সময়ের আলো : গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আপনার বিস্তৃত কাজ রয়েছে। সময়ের আলোর পাঠকদের জন্য সংক্ষেপে ওই তিন নির্বাচন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
বদিউল আলম মজুমদার : বিগত তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। ২০১৪ সালে আমাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালেও হরণ করা হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে। ২০১৪ ছিল একতরফা নির্বাচন; মানুষের সামনে কোনো পছন্দ ছিল না, কোনো বিকল্প ছিল না। ২০২৪-এ আবারও একতরফা নির্বাচন। এই তিনটি নির্বাচন আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো লঙ্ঘন করেছে। এ ছাড়া তিনটি নির্বাচনেই আমাদের আদালতের আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাসেম মামলার রায় লঙ্ঘন করেছে। ওই মামলার রায়ে বলা আছে, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের খাতিরে নির্বাচন কমিশন আইনকানুন-বিধিবিধান সংযুক্ত/বিযুক্ত করতে পারে। তাদের সেই ‘ইনহেরেন্ট’ বা অন্তর্নিহিত ক্ষমতা দেওয়া আছে। দিনকে রাত আর রাতকে দিন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তারা সবকিছুই করতে পারে। সেই তারাই যখন বলে আমাদের কাজ শুধু নির্বাচন করা, কেউ না এলে এলো না; তখন এটি সুস্পষ্টতই জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। কারণ তাদের সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নির্বাচনি ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে। গণতন্ত্রকে বেগবান করতে। কিন্তু তারা তো সেটি করেননি। বস্তুত এগুলো নির্বাচনের সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে না। বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পহীন নির্বাচন কোনো নির্বাচনই নয়। আইনের অঙ্গনে বহুল ব্যবহৃত ‘ব্ল্যাকস ল ডিকশনারি’ অনুযায়ী, নির্বাচনের অর্থ হলো বিকল্প থেকে বেছে নেওয়া।
সময়ের আলো : বিগত তিনটি নির্বাচন যারা পরিচালনা করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে কি?
বদিউল আলম মজুমদার : সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রযোজ্য হবে সিইসিসহ আমাদের নির্বাচন কমিশনারদের ওপর। তারাই সিদ্ধান্ত নিতে পারত, নির্বাচন আমরা করব না। বিরাজমান পরিস্থিতিতে আমাদের যে সাংবিধানিক নির্দেশনা, তার সঙ্গে এই নির্বাচনি পরিবেশ সঙ্গতিপূর্ণ হবে না। কিন্তু মাঠে যারা কাজ করেছে, প্রায় ১০ লাখ ব্যক্তি এই নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত। তারা যেই ভূমিকা পালন করেছে, তাতে বলা যায় তারা নির্বাচনি অপরাধ করেছে। আমাদের আরপিওতে নির্বাচনি অপরাধের শাস্তির বিধান আছে। সেই অনুযায়ী, এই যে হাজার হাজার লোক, তারা এই গুরুতর অপরাধ করে অবস্থাদৃষ্টে পার পেয়ে গেছে। বস্তুত আমরা একটি অপরাধীর সাম্রাজ্যে বসবাস করছি। আমাদের চারদিকে অপরাধী। যারা ওই তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছে, সাজা না হলেও তারা অপরাধী। আমরা প্রতি পদে পদে অপরাধীদের মুখোমুখি হচ্ছি।
সময়ের আলো : দোষীদের বিচারের আওতায় না এনে কি আমরা সামনে এগোতে পারব?
বদিউল আলম মজুমদার : এখন অন্তত কিছু লোকের হলেও তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তি দেওয়া উচিত। সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। আমরা কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি করেছিলাম। এটিও গঠন করা যেতে পারে। অনেকের মতে, এটি অতীব জরুরিও বটে। গত তিনটি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসন, রিটার্নিং অফিসার, পোলিং অফিসারসহ নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবাই অপরাধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাই নির্বাচনি অপরাধে অভিযুক্ত সব ব্যক্তিদের বিচারের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত।
সময়ের আলো : উচ্চ কক্ষ এবং নিম্ন কক্ষ নিয়ে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পরিসরে আলাপ হচ্ছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
বদিউল আলম মজুমদার : বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পরিসরে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। বিতর্ক হচ্ছে। যার মধ্যে দিয়ে আমি মনে করি একটি সুন্দর কিছুই হবে। বিভিন্ন অংশীজনের মতামতের বিষয়ও এখানে জড়িত।
সময়ের আলো : নির্বাচনে টাকার খেলা ও পেশিশক্তির ব্যবহার কি বন্ধ হবে?
বদিউল আলম মজুমদার : নির্বাচনে টাকার খেলা, পেশিশক্তির ব্যবহার, ইভিএম ব্যবহারের যৌক্তিকতা, এগুলো নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে নতুন করে কাজ করতে পারি কি না সেটিও আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার। আর নির্বাচনের অনেক ধাপ আছে, ভোটার তালিকা ঠিক করতে হবে। নির্বাচনি আসনবিন্যাস সঠিক করতে হবে। কারও স্বার্থে কোনো কিছু করা যাবে না। নির্বাচনের সময় প্রার্থিতায় আগ্রহী সবাই যেন প্রার্থী হতে পারেন। ভোটাররা যেন ভোট দিতে পারেন। টাকার খেলা কিংবা সহিংসতা যেন না হয়। ভোটগণনা যেন সঠিকভাবে হয়। পর্যবেক্ষণ যেন হয়। একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হলো নির্বাচন; যা এক দিনের বিষয় নয়। এই প্রক্রিয়াটা সঠিক হতে হবে। এ জন্য শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, এর সঙ্গে আরও অংশীজন আছে। গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কারণ নির্বাচনের জন্য ১০ লাখের মতো জনবল প্রয়োজন হয়। তারা প্রায় সবাই আসেন প্রশাসন থেকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। এই ব্যক্তিরা যেন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তারা দলীয়ভাবে মতান্ধ হলে নির্বাচনকে প্রভাবিত করবেন। স্বচ্ছ থাকবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সদাচরণ করতে হবে। নির্বাচনের দিনেও অনেক রকম চ্যালেঞ্জ থাকে-এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার পথ-পদ্ধতিও আমাদের বের করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের সংবিধানেও পরিবর্তন আনতে হবে।
সময়ের আলো : নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারের প্রশ্ন তো সাংবিধানিক সংস্কার প্রশ্নের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আপনি নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান। অন্যদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান শাহদীন মালিক। এই দুই কমিশনের মধ্যে সমন্বয় কীভাবে হবে?
বদিউল আলম মজুমদার : সমন্বয় তো হতেই হবে। কারণ সংবিধান ও নির্বাচন একে অন্যের পরিপূরক। নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন কিছু সংস্কার প্রয়োজন হবে, যার জন্য অবশ্যই সংবিধান সংশোধন করতেই হবে। আমি আশা করছি, আমরা যৌথভাবে কাজ করতে পারব। এখন আমাদের কাছে যদি অংশীজনদের পক্ষ থেকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনের সুপারিশ আসে, এটি পরিবর্তন করা সম্ভব একমাত্র সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। সংবিধান সংশোধন কমিটির সংস্কার প্রস্তাবে এটি থাকতে হবে। এ ছাড়া আরও কিছু ক্ষেত্রের পরিবর্তনের প্রশ্ন সামনে আসবে, যেগুলো দুই কমিটির সঙ্গেই সম্পৃক্ত। সুতরাং অবশ্যই সমন্বয় দরকার হবে।
সময়ের আলো : সংস্কারকৃত নির্বাচনব্যবস্থায় কি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক পার্লামেন্ট হওয়ার সুযোগ আছে?
বদিউল আলম মজুমদার : আগামী জাতীয় নির্বাচন আনুপাতিক ভিত্তিতে না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। কারণ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন করতে গেলে তা আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তার জন্য আমাদের বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন করে প্রণয়ন করতে হবে। অথবা পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলা নিয়ে আমরা যে রিভিয়্যুর আবেদন করেছি, আদালতে এ দুটোর ইতিবাচক রায় হলে গণভোটের বিধান ফিরে আসবে। তবে শুধু গণভোটের বিধান ফিরে এলেও এটি করা যাবে না। কারণ গণভোট কয়েকটি অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে তাই অন্য অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রেও গণভোটের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ সংবিধান সংশোধনের ১৪২ অনুচ্ছেদকেও গণভোটের আওতায় নিতে হবে। তবে এই পরিবর্তনগুলোর জন্য সংশ্লিষ্ট সবার ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে। সবার ঐকমত্যে এলে আগামী নির্বাচনের পরে নতুন সংসদ এগুলো বাস্তবায়ন করবে। আর যদি আমরা বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করতে চাই, তা হলে আমাদের গণপরিষদ গঠন করতে হবে। তারও বহু ঝুঁকি আছে। কারণ নতুন পরিষদ কিন্তু ১৯৭২ সালের পরিষদের মতো হবে না। এর চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। এগুলো আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না তা নিয়েও চিন্তাভাবনা করতে হবে।
সময়ের আলো :অনেকেই মনে করেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিতে পারে…
বদিউল আলম মজুমদার : কোনো সংস্কারই অ্যাবসিলিউট বা পারফ্যাক্ট না। প্রত্যেকটিরই ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক আছে। বাস্তবে এর প্রতিফলন হবে কি না তা নির্ভর করবে এটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, চর্চা করা হয়, তার ওপর। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের কথা উঠতে পারে। আবার কারও কারও মতে আওয়ামী লীগও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনব্যবস্থার বিরোধিতা করতে পারে। কারণ তাদের ধারণা আওয়ামী লীগের দুর্দিন কেটে যাবে। যেহেতু আওয়ামী লীগের একটি জনসমর্থন আছে। ফলে তারাও এর বিরোধিতা করতে পারে। আমার মতে, এই মূহূর্তে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন খুবই কঠিন। কারণ শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের দলের অনেকেই পালিয়ে গেছে। নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কাউকে এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, আনুপাতিক ব্যবস্থা নিয়েও কিন্তু গুরুতর প্রশ্ন আছে। অনেক জায়গায় দেখা গেছে, আনুপাতিক ব্যবস্থায়ও জালিয়াতি করা যায়। কারা পার্লামেন্টে যাবেন, এটি টাকার বিনিময়ে নির্ধারণের সম্ভাবনা থাকে এই পদ্ধতিতে। যেহেতু মানুষ দলকে ভোট দেয়, কোনো ব্যক্তিকে না। ফলে দলই নির্ধারণ করে পার্লামেন্টে কে যাবেন।
সময়ের আলো : নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কারের জন্য তিন মাস কি যথেষ্ট সময়? নাকি সংস্কারে আরও সময় লাগবে? সে ক্ষেত্রে কি নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে?
বদিউল আলম মজুমদার : আমরা সবাই চাইলে অবশ্যই তিন মাসে সম্ভব। একটু দ্রুত হলেও আমাদের সুপারিশগুলো দিতে হবে। আর সংস্কার তো ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শুধু নির্বাচন সংস্কার কমিশনই না, সব কমিশনের কাজই দ্রুততর সময়ে করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল রুটিন সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ১৫-১৬ বছরের জঞ্জাল দূর করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তারপরেও জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস পেতে পারে।
সময়ের আলো : একটু আগেই আপনি বাহাত্তরের গণপরিষদের কথা বলছিলেন। সে সময় সব অংশীজনের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়নি; এমন বিতর্ক রয়েছে। আপনার কি মত?
বদিউল আলম মজুমদার : হ্যাঁ, বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে ন্যায্য বিতর্ক এবং গুরুতর প্রশ্ন আছে। কিন্তু এটি হয়ে গেছে। নদীতে জল গড়িয়ে গেছে। এখন তো আমরা নতুন করে আর বদলাতে পারব না এবং আদালত এটি ‘কনডোন’ বা মার্জনা করে দেবে। কারণ এটি ঘটে গেছে। আমরা আর ইতিহাসের চাকা ঘোরাতে পারব না। বাহাত্তর সালেও ফিরে যেতে পারব না।
সময়ের আলো : তা হলে কি আমরা নতুন ইতিহাস রচনা করতে পারব না?
বদিউল আলম মজুমদার : অবশ্যই আমরা নতুন ইতিহাস রচনা করতে পারি। এখন যদি গণপরিষদ হয়, এই পরিষদ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। কিংবা আমরা যদি সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংশোধন করতে চাই, তা হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের সবার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এটি করতে হবে।
তথ্য সূত্র: সময়ের আলো | ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪