অবশেষে মাননীয় নির্বাচন কমিশনারদের বোধোদয় হলো। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল এবং চারজন নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, বেগম রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান পদত্যাগ করলেন। অনেক বিলম্ব ও গড়িমসির পরেও শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমি আউয়াল কমিশনের সদস্যদের ধন্যবাদ জানাই।
আমি জানি না, কমিশনের সদস্যরা বিবেকের দংশনে নাকি নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে পদ ছেড়েছেন। বিবেকের তাড়নায় পদত্যাগ করলে এটি বড্ড দেরি হয়ে গেছে। প্রশ্ন জাগে, গত দুই বছর তাদের বিবেক ছিল কোথায়?
আউয়াল কমিশন তাদের নিয়োগের পরপরই পদত্যাগ করতে পারত। নৈতিকতাবোধ থাকলে এবং বিবেকবান হলে তারা তা-ই করতেন।
কারণ তাদের নিয়োগটি ছিল আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে একটি কারসাজিমূলক অপকর্ম।
বিষয়টি আরও খোলাসা করে বলা যাক। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ অনুযায়ী রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের সুপারিশে ওই আইনের অধীনে গঠিত তৎকালীন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (পরে প্রধান বিচারপতি) ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতার সঙ্গে বাছাই করে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য ১০ জন ব্যক্তির নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করার কথা। কিন্তু বাছাই কমিটি তার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিষয়টি উন্মুক্ত করে দেয়, যার ফলে যে কোনো ব্যক্তি নিজের নামসহ যে কোনো ব্যক্তির নাম কমিশনে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা ছিল আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
অনেকেরই স্মরণে আছে যে, আমাদের অতি প্রিয় প্রয়াত জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদের জন্য হাবিবুল আউয়ালের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে সমস্যাটি ছিল যে, জাফর ভাই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য আইনগতভাবে যোগ্য ছিলেন না। আমরা নিশ্চিত যে, এভাবে আইনগতভাবে অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা মনোনীত হয়ে অন্য কমিশনাররাও আইনবহির্ভূতভাবে কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
কতজন আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তা জানার সর্বতো প্রচেষ্টা চালিয়েও আমাদের পক্ষে তা জানা সম্ভব হয়নি। মন্ত্রিপরিষদের কাছে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে দরখাস্ত করেও কে কার নাম প্রস্তাব করেছে, গোপনীয়তার অজুহাতে তা জানা যায়নি। দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য কমিশনে গিয়েও আমরা কোনো প্রতিকার পাইনি। কমিশন অজুহাত দিয়েছে যে, আমাদের তথ্য দিলে ব্যক্তির গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হবে। কিন্তু যারা নাম প্রস্তাব করেছে, তারা রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠন, ব্যক্তি নয়। শেষ পর্যন্ত কে কার নাম প্রস্তাব করেছে, তা জানার জন্য আমরা আদালতের আশ্রয় নিয়েছি এবং প্রতিকারের অপেক্ষায় রয়েছি। তবে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত গোপনীয়তার প্রচেষ্টার ‘ডাল মে কুচ কালা হায়’ – সেই সন্দেহ উদ্রেক না করে পারে না।।
বিষয়টি যে আইনসিদ্ধ হয়নি, তা কি প্রধান বিচারপতি জানতেন না? সাবেক আইন সচিব হাবিবুল আউয়ালও কি তাদের নিয়োগটি যে আইনানুগ হয়নি, তা অনুধাবন করতে পারেননি? এ ছাড়া অনুসন্ধান কমিটিতে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসেনের অন্তর্ভুক্তি প্রশ্নের উদ্রেক না করে পারে না, কারণ তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।
আউয়াল কমিশনের সদস্যদের বিবেক যে হঠাৎ করে জাগ্রত হয়েছে, তা আরও প্রতীয়মান হয় গত বছর দুটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার মাধ্যমে, যাদের নাম কেউ আগে শোনেওনি। শুধু তাই নয়, অন্যায় এবং অনৈতিকভাবে তারা আরও অনেক দলকে নিবন্ধন দেওয়া থেকে বিরত ছিল, যারা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলের পর একই কমিশন থেকে নিবন্ধন পাচ্ছে। এমন ডিগবাজির কী ব্যাখ্যা তারা দেবেন?
সবচেয়ে দৃষ্টিকটু এবং পরম পক্ষপাতদুষ্টতা আউয়াল কমিশন প্রদর্শন করেছে গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির শান্তিপূর্ণ মিছিলে বিনা উস্কানিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহিংস আক্রমণ এবং তার পরের ঘটনাবলি থেকে। পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, ২৮ অক্টোবরের ঘটনার পর অনেক গায়েবি মামলা দিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বসহ প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সঙ্গে অতীতের গায়েবি মামলার শুনানি করে ১৫০০-এর মত বিএনপি নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয়। পুরো ২৮ অক্টোবর এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলি সাজানো হয়েছিল বিএনপি যেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে, সেজন্য। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এসব নাটকের পর নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এসব গ্রেপ্তারের বিষয়ে তাদের কিছুই করার নেই, যদিও নির্বাচন কমিশনেরই দায়িত্ব নির্বাচনের আগে সমতল ক্ষেত্র তৈরি করা।
আউয়াল কমিশনের এসব অপকর্মের শেষ ও সর্বাধিক ভয়ানক দৃশ্যটি ছিল গত ৭ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান। যদিও সংজ্ঞাগতভাবেই একতরফা নির্বাচন কোনো নির্বাচনই নয়। কারণ আইনের অঙ্গনে বহুল ব্যবহৃত ‘ব্ল্যাকস ল ডিকশনারি’ অনুযায়ী, নির্বাচনের অর্থ হলো বিকল্প থেকে বেছে নেওয়া। যেখানে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প থাকে না, তাকে নির্বাচন বলা যায় না। নির্বাচনের নামে এমন প্রহসন অনুষ্ঠানের পরিণতিই হলো গত কয়েক সপ্তাহে হাজারখানেক নিরাপরাধ ব্যক্তির প্রাণহানি এবং কয়েক হাজার ব্যক্তির আহত হওয়া। আউয়াল কমিশন যদি ৭ জানুয়ারির আগে বিবেকের দংশন অনুভব করত এবং নীতি-নৈতিকতার খাতিরে এ আত্মঘাতী নির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে সরে দাঁড়াত, তাহলে গত কয়েক সপ্তাহের মর্মান্তিক ঘটনাগুলো এড়ানো যেত। তাই এসব নিরপরাধ ব্যক্তির হতাহতের দায় কি আউয়াল কমিশন এড়াতে পারে? তাদের দায়বদ্ধতার আওতায় আনা কি এখন জরুরি নয়? কারণ অপরাধ করে পার পেয়ে গেলে অপরাধ উৎসাহিতই হয়।
পরিশেষে, আমাদের ভোটাধিকার নিয়ে ভবিষ্যতে আর যেন ছিনিমিনি খেলা না হয়, সে লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। এ কাজে নেতৃত্ব প্রদর্শনে এবং ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষে কয়েকজন সৎ, নির্ভীক ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য অনতিবিলম্বে উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : সম্পাদক, সুজন– সুশাসনের জন্য নাগরিক
তথ্য সূত্র: সমকাল | ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪