দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এই সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় মৌলিক পরিবর্তন আনা দরকার বলে মনে করে অনেকে। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে হবে।

নানা রকম সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। অনেকের মতে, রাজনীতিতেও একটা বড় সংস্কার দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে—এমন কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। এসব বিষয়ে কালের কণ্ঠ’র মুখোমুখি হয়েছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব। অনুলিখন : রায়হান রাশেদ

কালের কণ্ঠ : দেশের ক্রান্তিকালে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এটা তো শুধু দায়িত্ব নয়, বড় একটা চ্যালেঞ্জও বটে। কিভাবে দেখছেন?

বদিউল আলম মজুমদার : এটা দায়িত্ব, চ্যালেঞ্জ এবং একই সঙ্গে সুযোগ।

কম মানুষের জীবনে এমন সুযোগ আসে। মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা—আকাশচুম্বী আকাঙ্ক্ষা—যে একটা কর্তৃত্ববাদী জগদ্দল পাথর আমাদের ওপর চেপে বসেছিল, এটা যেন আবার ফিরে না আসে। দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের যেন পুনারাবৃত্তি না ঘটে—সে রকম একটা ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করার গুরুদায়িত্ব তাদের ওপর পড়েছে। সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটা তারা কতটুকু করতে পারবে, আমি জানি না।

আশা করি, তারা সফল হবে। তাদের সফল হতেই হবে। তারা যদি সফল না হয়, আমরা সবাই বিফল। আমাদের সবার দায়িত্ব তাদের সহায়তা করা। তাদের পাশে দাঁড়ানো। সর্বতোভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। 

কালের কণ্ঠ : অনেকের অভিযোগ, গণতন্ত্র গত ১৫ বছরে নির্বাসনে গিয়েছিল। আরো একটা বড় চ্যালেঞ্জ বোধ হয় এটাই, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা। সেটা কিভাবে শুরু করা যেতে পারে?

বদিউল আলম মজুমদার : আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটাতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য অনেক জিনিস দরকার। প্রথমত, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যথাযথ নির্বাচনী ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এমন নির্বাচনী ব্যবস্থা; যেটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য। এটা দিয়ে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হবে। কিন্তু একটা সরকার গণতান্ত্রিক হবে কি না হবে, তা নির্ভর করে নির্বাচন-পরবর্তী কর্মকাণ্ডের ওপর। তারা যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে, তারা যদি মানবাধিকার নিশ্চিত করে; গুম, খুন, আয়নাঘর, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মানুষকে হয়রানি—এসব যদি না করে, ফৌজদারি অপরাধ না করে, তাহলে মানবাধিকার সংরক্ষণ হবে। আরেকটা দিক হলো সমতা, ন্যায়পরায়ণতা। গত ১৫ বছরে আমাদের কী হয়েছে? একদল লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। তাদের সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হয়েছে। ন্যায়পরায়ণতা, সমসুযোগ—এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। জনগণের কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসন হলো কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসন। কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটবে। বলা সহজ, করা অনেক কঠিন। পাশাপাশি সঠিক ব্যক্তিদের নির্বাচনে আনতে হবে। বিভিন্ন সময় আমি লিখেছি, আমাদের গণতন্ত্র এমন হয়ে গেছে, যেটা টাকা দিয়ে কেনা যায়।

কালের কণ্ঠ : আমাদের যে নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচনী প্রক্রিয়া, এটাকে কি আপনি যথার্থ মনে করেন?

বদিউল আলম মজুমদার : আমাদের যে নির্বাচনী ব্যবস্থাটা আছে; যেমন—নির্বাচনপদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে এটাকে বলে পাস পাস পোস্ট—সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বা এক ভোট পেলেও ব্যক্তি নির্বাচিত হয়। আমাদের এই নির্বাচনপদ্ধতির পরিবর্তন দরকার। অনেকের দাবি, আমাদের সংখ্যাধিক্যের প্রতিনিধিত্ব দরকার, যাতে ছোট ছোট দলের প্রতিনিধিত্ব থাকে; যাতে এ রকম কর্তৃত্ববাদী, একমুখী, একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে। এভাবে আমাদের নির্বাচনপদ্ধতির কিছু পরিবর্তন আনা দরকার। সংসদের উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষ থাকবে কি না—এ রকম অনেক পরিবর্তন আনা দরকার। নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। এই কমিশন নিরপেক্ষ হওয়া দরকার। এই কমিশন সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তোলা দরকার। এ জন্য আইন দরকার। আইনটা সঠিক হতে হবে।

এই যে বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে—২০২২ সালে একটা আইন করেছে, এটা কোনো আইন নয়। আগে যে প্রজ্ঞাপন ছিল, এই প্রজ্ঞাপনটাকে আইন হিসেবে সংসদে পাস করেছে। শুধু একটা জিনিস যুক্ত করেছে, একটা দায়মুক্তির বিধান যোগ করেছে। এই আইনটা সংশোধন করতে হবে। আমাদের অনেকগুলো নির্বাচনী আইন আছে; যেমন—গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, একটা গুরুত্বপূর্ণ আইন। ভোটার তালিকা তৈরির আইন আছে, সীমানা প্রতিনির্ধারণের আইন আছে—এ রকম অনেকগুলো আইন আছে। এই আইনগুলোও সঠিক হতে হবে। আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সঠিক হতে হবে। আরপিওটা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য, অন্যান্য আইনও গ্রহণযোগ্য। নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ আইনটা সঠিক নয়। এই আইনগুলোর আলোকে, যেমন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের ভিত্তিতে, সঠিক ব্যক্তিদের স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে, যাতে তাঁরা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হন। কোনো দলের প্রতি নয়, কোনো দলের প্রতি তাঁদের আনুগত্য যেন না থাকে।

নির্বাচনের অনেক ধাপ আছে, ভোটার তালিকা ঠিক করতে হবে। নির্বাচনী আসনবিন্যাস সঠিক করতে হবে। কারো স্বার্থে কোনো কিছু করা যাবে না। নির্বাচনের সময় প্রার্থিতায় আগ্রহী সবাই যেন প্রার্থী হতে পারেন। ভোটাররা যেন ভোট দিতে পারেন। টাকার খেলা যেন না হয়। সহিংসতা যেন না হয়। ভোটগণনা যেন সঠিকভাবে হয়। পর্যবেক্ষণ যেন হয়। এ রকম একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হলো নির্বাচন; এক দিনের বিষয় নয়। এই প্রক্রিয়াটা সঠিক হতে হবে। এ জন্য শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, এর সঙ্গে আরো অংশীজন আছে। গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কারণ নির্বাচনের জন্য ১০ লাখের মতো লোকের প্রয়োজন হয়। তাঁরা প্রায় সবাই আসেন প্রশাসন থেকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। এসব ব্যক্তি যেন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা দলীয় হলে নির্বাচনকে প্রভাবিত করবেন। স্বচ্ছ থাকবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সদাচরণ করতে হবে। নির্বাচনের দিনেও অনেক রকম চ্যালেঞ্জ থাকে—এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে।

কালের কণ্ঠ : শুধু তো নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচনী প্রক্রিয়া নয়, মৌলিক পরিবর্তনটা বোধ হয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দরকার? কী মনে করছেন?

বদিউল আলম মজুমদার : অবশ্যই, আমাদের সব কিছু ভেঙে পড়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে।’ আমাদের এখানে যেমন এক ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, এক ব্যক্তি হ্যাঁ বললে হ্যাঁ। এক ব্যক্তি তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সব কিছু দলীয় করেছেন। সব কিছু তিনি কুক্ষিগত করেছেন। সব কিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। তিনি যখন পলায়ন করলেন, সব কিছু ভেঙে পড়েছে। সব প্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব দিতে হবে। সঠিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে। নিয়ম-নীতি, পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে। আইনের পরিবর্তন করতে হবে। অনেক কিছু করণীয় রয়েছে।

কালের কণ্ঠ : সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। সংস্কার শব্দটি ছোট, কিন্তু অর্থ তো ব্যাপক। রাজনীতিতেও তো একটা বড় সংস্কার দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এটা কিভাবে শুরু করা যেতে পারে?

বদিউল আলম মজুমদার : সংস্কারের কথা বলছেন। জানেন, এই সংস্কার কথাটা আমাদের দেশে গালি শব্দে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বলা হতো সংস্কারপন্থী। ২০০৭ সালে যখন এক-এগারো ঘটল, তখন কিছু লোক ওই প্রেক্ষাপটে সংস্কারের কথা বলেছিল। রাজনৈতিক দলের সংস্কার, স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্রের কথা বলেছিল। আরো কিছু প্রশ্ন তখন উঠেছিল। যেহেতু দুই নেত্রী গণতন্ত্রের চর্চা করছেন না, তাঁদের বাদ দেওয়ার কথাও উঠেছিল। এসব বলায় কিছু রাজনীতিবিদ সংস্কারপন্থী বলে পরিচিতি পান। সংস্কার শব্দটা গালিতে পরিণত হয়। কিন্তু তখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার যদি করা হতো, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা হতো, স্বচ্ছতা তৈরি হতো। আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক দল নেই, এটাকে সিন্ডিকেট বলতে পারেন। এরা টাকা-পয়সা এনে তথাকথিত নির্বাচন করে ক্ষমতায় যায়—এটা তাদের জন্য ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ড। তাই অনেকগুলো ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। এটাই সংস্কার। আমাদের পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া সংস্কার করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করতে হবে। সংবিধানের সংস্কার করতে হবে। আইনের সংস্কার করতে হবে। অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। অনেক আইনকানুন, বিধি-বিধানকে যুগোপযোগী করতে হবে, যাতে এগুলো গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের দেশে বিতর্ক আছে। এটা নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও বিপরীতমুখী অবস্থানে। আপনি কিভাবে দেখছেন?

বদিউল আলম মজুমদার : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উপস্থাপন করেছিল বস্তুত জামায়াত। আওয়ামী লীগ জামায়াতের সেই দাবি গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাতীয় পার্টি সবাই মিলে বিরাট আন্দোলন করেছিল ১৯৯৬ সালে। এটা সহিংস আন্দোলন ছিল। এই আন্দোলনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে একটা জনমত তৈরি হয়েছিল। বিএনপি এটা প্রথম দিকে নাকচ করে দেয়। তারা বলেছে, এটা সংবিধানে নেই। শেষ পর্যন্ত তারাও এ ব্যাপারে একমত হয়েছে। একমত হয়ে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একতরফা নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে তারা পদত্যাগ করেছে; অনেকটা নাটকীয়ভাবে। পরবর্তীকালে বিএনপি এটা নিয়ে কিছু কারসাজি করার চেষ্টা করেছে। বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এসে সম্পূর্ণ অসাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিল অনেকগুলো মিথ্যাচারের ভিত্তিতে, প্রতারণার ভিত্তিতে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ফলে কী হলো। আমাদের দেশে চারটি নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে; তিনটি হলো সাংবিধানিক, আরেকটি সমঝোতার ভিত্তিতে ১৯৯১ সালে। এই চারটি নির্বাচনই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল; কোনোটা বেশি, কোনোটা কম। দলীয় সরকারের অধীনে বাকি আটটি নির্বাচন; সব কটি বিতর্কিত ছিল। এই চারটি নির্বাচন—যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কায়েম ছিল, সেখানে যারা ক্ষমতায় ছিল অতীতে, তারা আর ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেনি। দলীয় সরকারের অধীনে ওই আটটি নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় ছিল, তারাই আবার ফিরে এসেছে।

কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়। আপনি বিষয়টি কিভাবে দেখেন?

বদিউল আলম মজুমদার : এটা চরম জালিয়াতি করেছে। জালিয়াতি ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে এবং স্বার্থ প্রণোদিত হয়ে করেছে। ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তিন-চার লাইনের একটা সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়েছেন, ওটাই কিন্তু রায়। পরে যেটা ১৬ মাস পরে করেছেন, সেটা হলো বিস্তারিত রায়। ওটার সঙ্গে অলংকার যুক্ত করেছেন। ওটাই আসল রায়। ওই রায়ে বলা হয়েছে, ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে, জনগণ এবং রাষ্ট্রের স্বার্থে। কারণ রাষ্ট্র এবং জনগণের কল্যাণ হলো সর্বোচ্চ আইন। পরবর্তী দুই নির্বাচন—২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচন—তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। যদি সংসদ চায়, তাহলে বিচারপতিদের বাদ দেওয়ার জন্য তারা ত্রয়োদশ সংশোধনী সংশোধন করতে পারে। ভাষাটা ছিল প্রসপেক্টিভলি ডিকলার অন কনস্টিটিউশন অর্থাৎ দুই টার্মের পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হবে। সংসদের এখতিয়ার হলো শুধু বিচারপতিদের বাদ দেওয়া। বিচারপতিরা তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা। বিচারপতিদের বাদ দেওয়ার জন্য তারা ত্রয়োদশ সংশোধনী সংশোধন করতে পারে। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, সেটা চরম বিভ্রান্তিমূলক। সোজাসাপ্টা বলতে গেলে এটা মিথ্যাচার। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমি বাতিল করিনি, আদালত বাতিল করেছেন। পরে নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগবে। এটা সত্য নয়। শুধু তা-ই নয়, পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে সংবিধানকে সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে। সংবিধান সংশোধন করার জন্য একটা পদ্ধতি আছে, আমাদের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতিটা বলা আছে, ওই পদ্ধতি অনুযায়ী সংবিধানে কতগুলো অনুচ্ছেদ যদি সংশোধন করতে হয়, তাহলে গণভোট করতে হয়। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের আগে গণভোট করেনি। এটা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

আরেকটা হলো সংবিধানের এই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশকে অসংশোধনযোগ্য করা হয়েছে। এটা করা যায় না। এক সংসদ পরের সংসদের হাত-পা বেঁধে দিতে পারে না। এটা অসাংবিধানিক।

আরেকটা হলো পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের আগে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের ফলে সংসদ একটা বিশেষ কমিটি করে। কমিটি হলো ১৫ সদস্যের। এর মধ্যে ১২ জন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা; এটার প্রধান ছিলেন বেগম সাজেদা চৌধুরী, উপপ্রধান ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বাকি তিনজন ছিলেন তাঁদের জোটসঙ্গী। যেমন—রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু ও জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এই কমিটি সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রেখেই সংবিধান সংশোধন করা হবে। ২৯ মে এই সিদ্ধান্ত নেয়। ৩০ মে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী নাকচ করে দেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের একদল নেতাকে নিয়ে ওই কমিটির সামনে তাঁদের মতামত উপস্থাপন করেছেন। তাঁদের মতামতে বলেছেন, তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রেখেই সংবিধান সংশোধন করা হবে। সংসদীয় কমিটি যখন সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিল, প্রধানমন্ত্রী নাকচ করে দিলেন। তিনি যে আগে সুপারিশ করে আসছিলেন, সেটার বরখেলাপ করলেন। এটাও অসাংবিধানিক। এই প্রস্তাবটা দেওয়ার দরকার ছিল সংসদে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এটা নাকচ করে দিলেন। এটাকে বলে সেপারেশন অব পাওয়ার; ক্ষমতার পৃথককরণ নীতির পরিপন্থী। এটাও সংবিধান লঙ্ঘন।

আরেকটা হলো, সংবিধানের কতগুলো অলিখিত বিষয় থাকে। এটাকে বলে বেসিক স্ট্রাকচার মানে মৌলিক কাঠামো। যেমন—একটা ভবনের পিলারগুলো হলো মৌলিক কাঠামো। এখন পঞ্চদশ সংশোধনী যদি বাতিল না হয়, তাহলে যারা আমরা পরিবর্তনের কথা বলছি, তারা সবাই ফাঁসিকাষ্ঠে উঠতে পারি। কারণ সংবিধানের সাত অনুচ্ছেদে বলা আছে, কেউ যদি এই সংবিধান পরিবর্তনের জন্য কিংবা জোর করে সংবিধান বাতিল করে, এমনকি দাবি করে, তাহলে তারা রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে। তাই পঞ্চদশ সংশোধনী অত্যন্ত ভয়াবহ একটা সংশোধনী। এটা বাতিল হওয়া দরকার। এটা বাতিল হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসবে। তখন অন্তর্বর্তী সরকার সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আর কী কী পরিবর্তন আনা দরকার, সেই পরিবর্তনটা আনতে পারে।

কালের কণ্ঠ : গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ, যা অলঙ্ঘনীয়। সে বিবেচনায় গত তিনটি নির্বাচন আপনি কিভাবে দেখছেন?

বদিউল আলম মজুমদার : তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। যে গণতন্ত্র হলো মানুষের ভোটাধিকার দিয়ে শুরু হয়। ২০১৪ সালে আমাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালেও হরণ করা হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে। ২০১৪ ছিল একতরফা নির্বাচন; মানুষের সামনে কোনো পছন্দ ছিল না, কোনো বিকল্প ছিল না। বিকল্পহীন নির্বাচন কোনো নির্বাচনই নয়। ২০২৪ আবারও একতরফা নির্বাচন। আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো লঙ্ঘন করেছে। 

কালের কণ্ঠ : পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি জবাবদিহিমূলক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণে আমাদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?

বদিউল আলম মজুমদার : পদ্ধতি, প্রক্রিয়া, প্রতিষ্ঠান, আইনকানুন, সংবিধান; এগুলোর আমূল পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদকে এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দিতে হবে। আমাদের সবাইকে উপদেষ্টা পরিষদের সফলতার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। কারণ তারা সফল না হলে আমরা সবাই ব্যর্থ। 

কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।

বদিউল আলম মজুমদার : আপনাকেও ধন্যবাদ।

তথ্য সূত্র: কালের কণ্ঠ |  ২৬ আগস্ট, ২০২৪