অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক। সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যের খুনের ঘটনা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। এর আগেও কয়েকজন সংসদ সদস্য অপরাধমূলক কর্মকান্ডে খবরের শিরোনাম হয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী

দেশ রূপান্তর : দীর্ঘদিন ধরে আপনারা বলে আসছেন, আমরাও লিখে আসছি ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন’ শব্দ দুটি। যেটা এখন অনেকটা ক্লিশেই হয়ে গেছে। কিন্তু পরিস্থিতির তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন নেই। সম্প্রতি ভারতে একজন সংসদ সদস্য খুন হলেন, যার সঙ্গে হুন্ডি, চোরাচালানে জড়িত থাকার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। এর আগের সংসদে আরেকজন সংসদ সদস্য কুয়েতে মানবপাচার করতে গিয়ে ধরা পড়লেন। সব মিলিয়ে এসব ঘটনার পরে আপনার মন্তব্য কী?

বদিউল আলম মজুমদার : দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দায়বদ্ধতার কাঠামো ভেঙে গিয়েছে। সরকারের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা হয় দুভাবে। নির্বাহী বিভাগের দায়বদ্ধতা একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের মাধ্যমে তৈরি হয়। একটা হলো সংসদীয় কমিটিগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। আরেকটা হলো প্রতি পাঁচ বছর পরপর জনগণের কাছে ভোট ভিক্ষা চাইতে হলে সরকারকে দায়বদ্ধ হতে হয়। এই দায়বদ্ধতার কাঠামো ভেঙে গিয়েছে। এখন সরকার আর জনগণের স্বার্থে কাজ করছে না। যারা তাদের ক্ষমতায় এনেছে, ক্ষমতায় রাখছে তাদের হয়ে কাজ করছে বা তাদেরই সব, মানে যা খুশি করতে দিচ্ছে। এমপি সাহেব যা করতে চায় তা করতে দিচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তারা যা করতে চায় তা করতে দিচ্ছে, পুলিশ যা করতে চায় তা করতে দিচ্ছে। কারণ তাদের জনগণের দরকার হয় না। ওরাই তাদের ক্ষমতায় আনে, ক্ষমতায় রাখে। এই দায়বদ্ধতার কাঠামো ভেঙে যাওয়ার ফলেই এখন যথেচ্ছা যা হচ্ছে। আমাদের দ্বি-দলীয় শাসন ব্যবস্থা ভেঙে গিয়েছে। সরকারের দমন-পীড়ন, একই সঙ্গে বিরোধী দলের কিছু ভুলভ্রান্তি এবং তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। যেটা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো করুণ অবস্থায় পৌঁছেছে। এগুলোতে দুর্নীতির আখড়া হয়ে পড়েছে অর্থাৎ অল আর করাপ্টেড। সব জায়গাতে দলীয় ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে। প্রশাসনে মেধাশূন্যতা দেখা দিয়েছে। দলীয়করণের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধা ও যোগ্যতা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। আমাদের রাজনীতিতে বিরাজনীতিকরণ হয়েছে। রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের পরিবর্তে ব্যবসায়ীরা এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই এখন সবকিছু পরিচালনা হচ্ছে।

দেশ রূপান্তর : একটা হচ্ছে নির্বাহী দায়বদ্ধতা, আরেকটা হচ্ছে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। আপনি বলছেন এই দুই জায়গাই ভেঙে পড়েছে। এর পেছনের কারণটা কি আমাদের দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার অবলোপন?

বদিউল আলম মজুমদার : হ্যাঁ, এইটাই। ধরেন রাজনীতির ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা টিকেছিল দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে। যদি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ বা বিরোধী দল থাকে তাহলে সরকারি দল যা ইচ্ছা তা করতে পারে না। আরেকটা হলো কতগুলো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। যেমন সংসদের মাধ্যমে, বিচার বিভাগের মাধ্যমে, দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলো যখন কার্যকর হয় না তখন এই প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতাও চলে যায়। আরেকটা দায়বদ্ধতা হলো ভোটের মাধ্যমে, যেটা জনগণের কাছে। পাঁচ বছর পরপর যদি জনগণের কাছে ভোট ভিক্ষা চাইতে হয় তাহলেও সরকার যা ইচ্ছে তা করতে পারে না। পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই হলো নজরদারিত্বের বিষয়, একে অপরের ওপর নজরদারিত্ব করবে। নির্বাহী বিভাগের ওপর অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, সংসদ এরা নজরদারিত্ব করবে; জনগণেরও একটা নজরদারিত্বের ভূমিকা থাকে ভোটের মাধ্যমে। এই পুরো কাঠামোই ভেঙে গিয়েছে।

দেশ রূপান্তর : বিদেশে যে সংসদ সদস্য খুন হলেন, তিনি তো একটা সীমান্তবর্তী জেলার তিন তিনবারের সংসদ সদস্য। তার সম্পর্কে বেশ নেতিবাচক খবর আসছে। আমাদের আরেকজন সংসদ সদস্য আছেন, উনি আমাদের পার্বত্যাঞ্চলের সীমান্ত এলাকার সংসদ সদস্য, তার নামও বিভিন্ন সময় খবরে আসে। দেখা যাচ্ছে সংসদ সদস্যদের এসব কর্মকান্ড মিডিয়াতে আসছে, একদম অজানা নয়, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে স্টেপ নেওয়া হয় না।  

বদিউল আলম মজুমদার : শোনেন, শুধু একজন-দুজন নয়। আমাদের বিরাট সংখ্যক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেই বহু রকম অভিযোগ আছে। হয়তো চোরাচালান বা মাদক পাচার না; কিন্তু তাদের অনেক অন্যায়, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কথা প্রকাশও পায় এবং কেউ কেউ অনেক বাড়াবাড়ি করেও পার পেয়ে যাওয়ার অনেক অভিযোগ আছে। সবকিছু নিয়ন্ত্রিত করার এবং অযাচিত সুবিধা পাওয়ার বহু অভিযোগ আছে। এ জন্যই তো তাদের সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য এত প্রবল প্রতিযোগিতা। 

দেশ রূপান্তর : প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গটা বেশ ইন্টারেস্টিং। বলা হয়ে থাকে, মানি আর মাসেল বড় ফ্যাক্টর। মানবপাচারের দায়ে যে সংসদ সদস্য বিদেশে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, বলা হয়ে থাকে তিনি টাকা দিয়ে প্রতিপক্ষকে কিনে নিয়েছিলেন। আবার এবার যে সংসদ সদস্য খুন হলেন ওনার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক বলছেন যে, মনোনয়নের ক্ষেত্রে তার জনপ্রিয়তাকে বিবেচনা করা হয়েছিল। আপনার মন্তব্য কী?

বদিউল আলম মজুমদার : খারাপ লোকেরা যাতে মনোনয়ন না পায়, তারা যাতে নির্বাচিত না হয় এটা তিনভাবে ফিল্টারিং ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা। একটা হলো রাজনৈতিক দল। আমাদের ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক বললেন তার জনপ্রিয়তার কথা, তাহলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে ওটা কোনো ব্যাপার না! অপরাধ কর্মকাণ্ড যে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় হয় এটা তারই প্রতিফলন। অর্থাৎ রাজনৈতিক দল কোনো বাছবিচার করে না, কাকে মনোনয়ন দিল? এটা রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা। দ্বিতীয়ত হলো, ভোটারের মুখোমুখি যদি হতে হতো, তাহলে কিন্তু তার সুনাম, দুর্নাম, তার যোগ্যতা-অযোগ্যতা, তার অপরাধী কর্মকাণ্ড এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।

তৃতীয়ত হলো, সংসদের একটা কমিটি আছে সংসদীয় বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি কমিটি; এটা প্রিভিলাইজ কমিটি। এর মাধ্যমে সংসদ সদস্যরা বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা পায় এবং এটাও আশা করা হয় বা এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, সংসদ সদস্যরা স্বচ্ছতার সঙ্গে, দায়বদ্ধতার সঙ্গে, সততার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। এই কমিটি অত্যন্ত পাওয়ারফুল। এর নেতৃত্ব দেন স্পিকার। কোনো সংসদ সদস্য যদি সংসদ অবমাননা করে তাহলে কমিটি তাকে বহিষ্কার করতে পারে। তাদের দুর্নীতি, তাদের অপকর্ম, তাদের বিভিন্ন রকম বাড়াবাড়ি এগুলো হলো সংসদের মর্যাদাহানি অর্থাৎ সংসদের অবমাননা। ভারতে একবার দুর্নীতির দায়ে ৮-৯ সংসদ সদস্যকে বহিষ্কার করেছিল। বিভিন্ন সময় অভিযোগ এলেও আমাদের সংসদে গত ২০০৮ সাল থেকে একজন সংসদ সদস্যকেও বহিষ্কার করা হয়নি; একজনের অপকর্মের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একবার শুধু বিএনপির এক চিপ হুইপের বিরুদ্ধে একটা ইনভেস্টিগেশন হয়েছিল কিন্তু সংসদ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তো তারা যদি ব্যবস্থা না নেয়, এ রকম অপকর্ম তো হবেই।

দেশ রূপান্তর : সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা নিয়ে এক রকম কথা শোনা যায় যে, অনেক সময় নাকি সংসদ সদস্যদের আদেশে আসামি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। এটা কি সংসদ সদস্যদের আরও বেশি বেপরোয়া করে তুলছে?

বদিউল আলম মজুমদার : এটা তো সংসদের অবমাননা। শোনেন, যেটা প্রিভিলাইজ কমিটি অর্থাৎ সংসদ এবং সংসদ সদস্যদের অধিকার ও দায়মুক্তির কমিটি, এই কমিটির মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা আছে; তারা এমন কিছু করবে না যেটায় সংসদের মর্যাদাহানি হবে। মর্যাদাহানি হলে, কমিটির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছ। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

দেশ রূপান্তর : ফোন করে বা নোট দিয়ে আসামি ছাড়ানোর ক্ষমতা সংসদ সদস্যের নেই?

বদিউল আলম মজুমদার : এই ক্ষমতা নেই তার। সরকারের বৈধভাবে বল প্রয়োগের ক্ষমতা আছে কিন্তু এসব ব্যক্তিদের এই ক্ষমতা নেই, সে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করেছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নির্বাহী বিভাগের এবং পুলিশের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এবং একই সঙ্গে প্রিভিলাইজ কমিটিরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সংসদ সদস্য এই কাজের মাধ্যমে অন্য সংসদ সদস্যদের এবং সংসদের মর্যাদাহানি করেছে, জনসম্মুখে তাদের হেয় করেছে। এই জিনিস কেউ জানে না, এই জিনিস আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয় না; কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না। গত ২০০৮-এর পরে সাবের হোসেন চৌধুরী একটা বিল উত্থাপন করেছিলেন সংসদ সদস্যদের আচরণবিধির জন্য, এটা ওই কমিটিও পাস করেছিল, কিন্তু এটা সংসদে তোলা হয়নি এবং এটা পাসও হয়নি। তার মানে তাদের যথেচ্ছাচার করতে দেওয়া হচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, ভোটররা যদি ভোট দিতে পারতেন আর তারা যদি নির্বাচিত হয়ে আসে, তাহলেও তারা এ রকম করতে পারত না।

দেশ রূপান্তর : সব কিছুর সমাধান কি ভোটেই? নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ার ব্যাপারে তো সেই মানি, মাসেল, জনপ্রিয়তা যদি শেষ কথা হয়, তাহলে কি আর পরিবর্তন হবে?

বদিউল আলম মজুমদার : আগেও বলেছি, আবার বলছি তিনভাবে এসব লোকদের রাজনীতি থেকে, সংসদ থেকে দূরে থাকা যায়। একটা হচ্ছে রাজনৈতিক দল অপরাধীদের, যারা দুর্বৃত্ত, যারা খারাপ লোক তাদের মনোনয়ন দেবে না। রাজনৈতিক দলের তো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হলো খারাপ লোক বা দুর্বৃত্তদের মনোনয়ন না দেওয়া, দূরে রাখা। দ্বিতীয়ত, হলো যদি ভোটে দাঁড়াতে হয় তাহলে যে তথ্য দিতে হয় সেটা সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে তাহলে মানুষ জানতে পারবে। যদি সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হয় এগুলো মিডিয়ায় আসবে, বিভিন্নভাবে মানুষ জানবে, তাদের মানুষ ভোট  দেবে না। তৃতীয়ত, তারা যদি নির্বাচিত হয়েও আসে এবং তারা কোনো অপরাধের সাধে সংশ্লিষ্ট থাকলে সংসদের অধিকার আছে, গুরুত্বপূর্ণ কমিটি আছে সেটা দেখার। এই কমিটি সক্রিয় হলে এদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত।

দেশ রূপান্তর : লাস্ট যে ঘটনাটা ঘটল, এটার প্রভাব কতদূর পড়তে পারে বলে আপনি মনে করেন? নাকি এটাও অন্যান্য ঘটনার মতো আরেকটা ইস্যু আসার পরে পেছনে চলে যাবে?

বদিউল আলম মজুমদার : আমাদের এই দুর্বৃত্তের রাজনীতিতে কিছুই হবে না। কারণ আমাদের সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক যদি বলে তার জনপ্রিয়তার কথা; এ ক্ষেত্রে তার সুনাম, দুর্নাম বা দুর্বৃত্তপনা যাই হোক না কেন, তাতে কিছুই আসে-যায় না তাহলে তো কিছুই হবে না। তারা তো নিজেরাই এদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। এই কথার মাধ্যমে তো তাদের আশকারা দিচ্ছে।

দেশ রূপান্তর : অনেক ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।

বদিউল আলম মজুমদার : আপনাকেও ধন্যবাদ।

অনুলিখন : মোজাম্মেল হৃদয়

তথ্য সূত্র: দেশ রূপান্তর  ২৬ মে, ২০২৪