সম্প্রতি শেষ হওয়া গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ‘আমরা প্রমাণ করেছি যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ হতে পারে এবং এর বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতে পারে না’ (প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০২৩)।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন: ‘সার্বিক মূল্যায়নটা হচ্ছে পাঁচটি নির্বাচন ভালো হয়েছে। এটি জাতীয় নির্বাচনকে উৎসাহিত করবে।’ (বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম, ২১ জুন ২০২৩)।

এসব দাবি কি যৌক্তিক? এসব নির্বাচন থেকে কী বার্তাই–বা আমরা পেলাম?
এসব দাবির যৌক্তিকতা যাচাই করতে হলে প্রথমেই ‘নির্বাচনের’ সংজ্ঞা নিরূপণ করা আবশ্যক।

নির্বাচন হলো বিকল্প থেকে বেছে নেওয়ার ক্ষমতা, অধিকার ও সুযোগ। তাই যেখানে বিকল্প থাকে না, সেখানে নির্বাচনও হয় না। তবে বিকল্প হতে হবে যথার্থ। যেমন সেদ্ধ পানি মিনারেল ওয়াটারের বিকল্প হতে পারে, কারণ দুটোকেই নিরাপদ বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু ট্যাপের পানি এর কোনোটিরই বিকল্প নয়, তাই এ ক্ষেত্রে ‘নির্বাচনের’ও সুযোগ থাকে না।

এবারের সিলেটের সিটি নির্বাচনে বেশ কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আখতারুজ্জামান চৌধুরী নির্বাচনী হলফনামায় তাঁর বিদেশে থাকা সম্পদ প্রদর্শন করেননি, যার জন্য তাঁর মনোনয়ন ফরম বাতিল হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নির্বাচন কমিশন তা করেনি।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটির তথাকথিত নির্বাচনে মেয়র পদে, রূপক অর্থে, সেদ্ধ বা মিনারেল ওয়াটারের বিপরীতে ট্যাপের পানি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল, যার ফলে এসব ক্ষেত্রে ভোটারদের সামনে কোনো যথার্থ বিকল্প ছিল না। উপরন্তু বরিশালে সহিংসতার অভিযোগে ইসলামী আন্দোলনের সরে দাঁড়ানোর ফলে সিলেট ও রাজশাহী সিটির নির্বাচন অনেকটা অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়। তাই এই পাঁচটি সিটিতে মেয়র পদে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলা কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না বরং এগুলোকে সর্বোচ্চ ভোটাভুটির বহুলাংশে শান্তিপূর্ণ অনুশীলন বলাই সমীচীন।

পাঁচটি সিটিতে বহুলাংশে শান্তিপূর্ণ ভোটাভুটি হয়েছে, কারণ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কোনো প্রার্থী এগুলোতে ছিলেন না। পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে ২০১৮ সালের নির্বাচনের কথা, যেখানে বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং সেই ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের মদদে সরকার, মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই জয়-পরাজয়ের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রয়াত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ভাষায়, ‘নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের হাত থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তরিত হয়ে গিয়েছে’ (নির্বাচননামা, পৃ. ১৮৫)। বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল না বলেই এবারের ভোটাভুটি মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হয়েছে। আমেরিকার ভিসা নীতিতে পরিবর্তনও শান্তিপূর্ণ ভোটাভুটিতে ভূমিকা রেখেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এবং হবে—এমন আশ্বাস আমরা অতীতেও শুনেছি। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে তাদেরকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল: ‘…নির্বাচনে আসেন। অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে যারা জয়ী হবে, তারা ক্ষমতায় আসবে। নির্বাচনে কোনো হস্তক্ষেপ হবে না’ (প্রথম আলো, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮)। কিন্তু ২০১৮ সালের চরম বিতর্কিত নির্বাচনের কথা কারোরই অজানা নয়।

টিআইবি ৫০ নির্বাচনী এলাকায় পরিচালিত গবেষণার ভিত্তিতে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি ও নির্বাচনের দিনে নানা অনিয়মের তথ্য প্রকাশ করেছে। আমরাও সুজনের উদ্যোগে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে বহু গড়িমসির পর প্রাপ্ত কেন্দ্রভিত্তিক ভোটের তথ্য বিশ্লেষণ করে ভোটের বানোয়াট ফলাফলের চিত্র তুলে ধরেছি। তাই আবারও সুস্পষ্ট আশ্বাস সত্ত্বেও আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

গত পাঁচটি সিটিতে ভোট পড়ার হার ছিল: গাজীপুরে ৪৯ শতাংশ, খুলনা ৪৮ শতাংশ, বরিশাল ৫১ শতাংশ, সিলেট ৪৬ শতাংশ ও রাজশাহী ৫৬ শতাংশ। এসব ভোটের হার নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ এ ক্ষেত্রে ইভিএমের তেলেসমাতির অভিযোগও উত্থাপন করেছেন। প্রথম আলোর (১৪ জুন ২০২৩) ‘খুলনায় ভোটের হার নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস,’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী: ‘খুলনার বিভিন্ন দলের নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও পরাজিত মেয়র প্রার্থীরাও এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন…দিনভর ভোটের মাঠ ছিল একেবার ফাঁকা। এমন পরিস্থিতিতে কোথা থেকে এত ভোট পড়েছে, এটি তাঁরা বুঝতে পারছেন না।

আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীরা বলেছেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। ফলাফল ঘোষণায় তাঁদের পক্ষে যে ভোট দেখানো হয়েছে, সেটি তাদের প্রকৃত ভোট নয়। তাঁরা এমন অভিযোগও করেছেন যে ভোট পড়ার হার এবং নির্বাচনের ফলাফলে ‘কারসাজি’ করা হয়েছে।’ প্রসঙ্গত, ‘ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) না থাকার কারণে পুনর্গণনা করে ইভিএম ব্যবহারের ভিত্তিতে ঘোষিত ভোটের ফলাফলের সঠিকতা যাচাই করা অসম্ভব।

লক্ষণীয়, ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনের তুলনায় এবারকার মেয়র পদে গড় ভোট পড়ার হার ৫ দশমিক ২০ শতাংশ কম ছিল (বাংলা নিউজ টোয়েন্টি ফোর ডট কম, ২৩ জুন ২০২৩), যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এবার ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের হাজির করার লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়া সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীরা কেন্দ্রে ভোট হাজির করার সর্বৈব প্রচেষ্টা চালান। বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থাকায় এবং আমেরিকার পরিবর্তিত ভিসা নীতির কারণে এবার ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতাও ছিল না। ভোট পড়ার হারে এমন হ্রাস তাহলে কি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনতা এবং নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের অসন্তুষ্টি ও অনীহারই প্রতিফলন?অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেই–বা লাভ কী

এবারকার সিটি নির্বাচনে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে কোনো কোনো সিটিতে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত মেয়রদের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ কমে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, গতবারের তুলনায় এবারের বরিশালের মেয়রের ভোটের পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার কমে গেছে। খুলনার মেয়রের ভোটের পরিমাণ ২০ হাজার হ্রাস পেয়েছে। তবে ধর্মভিত্তিক দলের ভোট উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, গত পাঁচটি সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী তিনটিতে দ্বিতীয় অবস্থানে এবং দুটিতে তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীদের এমন ফলাফল কী বার্তা বহন করে, তা সবারই অনুধাবন করা জরুরি।

এবারের সিলেটের সিটি নির্বাচনে বেশ কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আখতারুজ্জামান চৌধুরী নির্বাচনী হলফনামায় তাঁর বিদেশে থাকা সম্পদ প্রদর্শন করেননি, যার জন্য তাঁর মনোনয়ন ফরম বাতিল হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নির্বাচন কমিশন তা করেনি।

তবে এ নিয়ে মামলা হয়েছে এবং আমরা আশা করি আদালত আইনের সঠিক ব্যাখ্যা দেবেন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান মিয়া, যিনি বহুলাংশে অপরিচিত প্রার্থী হয়েও তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে একটি চমক। এ চমক ইভিএমের বদান্যতায় ঘটেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা হলো, শাহজাহান মিয়া মনোনয়ন ফরমের সঙ্গে হলফনামা ও আয়করের বিবরণী দাখিল করেননি, যার জন্য তাঁর মনোনয়ন ফরম বাতিল হয়েছিল।

কিন্তু আপিল পর্যায়ে এগুলো জমা দিয়ে তিনি মনোনয়ন ফরম ফেরত পান, যা কোনোভাবেই আইনসিদ্ধ ছিল না। এই দুই প্রার্থীর ক্ষেত্রে সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ করতে কমিশন ব্যর্থ হয়েছে, যে বার্তা কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়।
পাঁচটি সিটিতে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে ভোটাভুটি হলেও জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, সে আশা করাও দুরাশা, কারণ জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতার রদবদল হতে পারে, তাই সে নির্বাচনের হিসাব-নিকাশই ভিন্ন।

এ ছাড়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ফিরিয়ে আনার কারণে পুরো নির্বাচনী মাঠই ভয়াবহভাবে ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে অসমতল হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে অতীতে কখনো দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি, এবারও নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চরম দলীয়করণের কারণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।

. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক

তথ্য সূত্র: প্রথমআলো  ১০ জুলাই, ২০২৩