নির্বাচন বাতিলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা হ্রাস করে গত ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এ সংক্রান্ত সংশোধনী পাস হয়। সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, ভোট গ্রহণের দিনের আগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) চাইলেও নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। এ ছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও পুরো আসনের (সংসদীয়) ফলাফল স্থগিত বা ভোট বাতিল করতে পারবে না ইসি। শুধু যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ থাকবে, সেসব ভোটকেন্দ্রের ফলাফল চাইলে স্থগিত করতে পারবে ইসি।

গত বছর ইসি আরপিওর ১৭টি ধারা সংশোধনের লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। ওই প্রস্তাবে ইসির পক্ষ থেকে নতুন উপধারা ৯১ক সংযুক্তির প্রস্তাব করা হয়, যাতে ভোট গ্রহণের পরেও পুরো নির্বাচনী এলাকার ফলাফল বাতিলের ক্ষমতা চাওয়া হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ৯১ক উপধারায় কমিশনের প্রস্তাব ছিল এ রকম: ‘ভিন্ন কোনো বিধান না থাকিলে, কমিশন– (ক) কোনো ভোটকেন্দ্র বা সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকার ফলাফল প্রকাশ স্থগিত করিতে পারিবে, যদি কমিশন নিশ্চিত হয় যে, সেই ভোটকেন্দ্র বা পুরো নির্বাচনী এলাকার ফলাফল বল প্রয়োগ, হুমকি, কারসাজি বা অন্য কোনো অসদাচরণ দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হইয়াছে এবং প্রয়োজনীয় সময়ের মধ্যে দ্রুত তদন্ত শেষে সরকারি গেজেটে পুরো নির্বাচনী এলাকার ফলাফল প্রকাশের নির্দেশনা দিবে অথবা নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্রের বা পুরো নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন বাতিলপূর্বক নতুন করিয়া নির্বাচন করিতে পারিবে।’ কিন্তু কমিশনের প্রস্তাব থেকে পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করার বিষয়টি বাদ দিয়ে ৪ জুলাই আরপিও সংশোধনী বিল সংসদে পাস হয়েছে।

আরপিও সংশোধনে ইসির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমি (৩০ আগস্ট ২০২২) এক নিবন্ধে দাবি করেছিলাম– উচ্চ আদালতের রায়ের সুবাদে যে ক্ষমতা কমিশনের ইতোমধ্যে আছে, তার জন্য ‘আইন মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হওয়াটা আত্মঘাতী হতে পারে– মন্ত্রণালয় কমিশনের প্রেরিত প্রস্তাবটি নাকচ করে দিতে পারে।’ আরপিওর সংশোধনী পাসের মাধ্যমে বাস্তবে তা-ই ঘটল। কিন্তু ইসির পক্ষ থেকে কোনোরূপ প্রতিবাদ জানানো হয়নি। বরং আইন না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। অথচ সংশোধনী বিলের ব্যাপারে ইসির যদি অসন্তুষ্টি থাকে, তাহলে আইনে পরিণত হওয়ার আগেই এর প্রতিবাদ জানানো উচিত। কারণ আইন হয়ে যাওয়ার পর কমিশনের খুব বেশি কিছু করার থাকবে না। অবশ্য বিলটি উত্থাপনের পর কমিশনের সদস্য রাশেদা সুলতানা দাবি করেছিলেন, ‘আরপিও সংশোধনে ইসির ক্ষমতা খর্ব নয়, বরং কিছুটা বাড়বে (প্রথম আলো, ২১ মে ২০২৩)। অথচ আইনমন্ত্রী কর্তৃক সংসদে উত্থাপিত বিলের পর্যালোচনা থেকে সব অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষক কমিটির ক্ষমতা খর্ব করার আশঙ্কা প্রকাশ করলেও কমিশনের এমন বক্তব্য থেকে প্রতিষ্ঠানটি কি আসলে সরকারের অনুগত বি-টিম কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক না করে পারে না।

কমিশনার রাশেদা সুলতানার বক্তব্য অনুযায়ী, কমিশন ৯১ক ধারায় কোনো পরিবর্তনের প্রস্তাব করেনি। কিন্তু ৬ জুলাই যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়– ‘ক্ষমতা’ কমানোর প্রস্তাব ইসি থেকেই গেছে। উল্লিখিত প্রতিবেদন থেকে প্রমাণিত– ইসি নিজেই তার ক্ষমতা হ্রাসের প্রস্তাব করেছে। তাই এটি অস্বীকার করার মাধ্যমে ইসি মূলত মিথ্যাচার করছে এবং জাতিকে বিভ্রান্ত করছে।

উল্লেখ্য, ৯১ক ধারায় বলা ছিল: ‘৯১। ভিন্নরূপ কোনো বিধান না থাকিলে, কমিশন– (ক) যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচনে বল প্রয়োগ, ভীতি-প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করিতে সক্ষম হইবেন না, তাহা হইলে ইহা যে কোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করিতে পারিবে।’ কিন্তু পাস হওয়া আরপিওর বিলে ‘নির্বাচন’ শব্দের পরিবর্তে ‘ভোট গ্রহণ’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

আপাতদৃষ্টিতে এটি শব্দগত পরিবর্তন মনে হলেও এর ব্যাপকতা অনেক গভীরে। কারণ নির্বাচন একটি প্রক্রিয়া, যা বলতে সাধারণত তপশিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ফলাফল গেজেটে প্রকাশ পর্যন্ত সময়কে বোঝায়। আর ভোট গ্রহণ বলতে বোঝায় শুধু ভোটের দিন। পূর্বে ৯১ক অনুচ্ছেদের শেষ লাইনে নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করার ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সংশোধিত বিলে নির্বাচন শব্দের স্থলে ভোট গ্রহণ শব্দ প্রতিস্থাপনের ফলে নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ের জায়গায় ভোট গ্রহণের যে কোনো পর্যায়ে সীমিত হয়ে যাবে। অথচ তপশিলের পর থেকে ভোট গ্রহণ ও গণনা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের হাত শক্ত না থাকলে পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া বানচাল ও অস্পষ্ট হবে। কমিশনের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাবে। তাই এই সংশোধনীর মাধ্যমে কমিশনের নিজের ক্ষমতা নিজেই খর্ব করার আত্মঘাতী প্রস্তাবের কারণ কী– তা আমাদের বোধগম্য নয়। উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা থাকার পরও সেই ক্ষমতা ও আত্মসম্মানবোধ নষ্ট করে কোন বিবেচনায় ইসি নিজের হাত-পা কেটে ফেলেছে, তাও আমাদের বোধগম্য নয়। অথচ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঠিকতা নিশ্চিত করা ও তা রক্ষার দায়িত্ব ইসির।

ইসি উপলব্ধি করতে পারে না, উচ্চ আদালতের রায়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার যে কোনো পর্যায়ে ফলাফল গেজেটে প্রকাশের আগ পর্যন্ত তাদেরকে নির্বাচনী ফলাফল বাতিল ও পুনর্নির্বাচনের নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষমতা আছে। নূর হোসেন বনাম মো. নজরুল ইসলাম মামলার [৪৫বিএলসি (এডি)(২০০০)] রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেন, ‘আমরা এ কথা পুনর্ব্যক্ত না করে পারি না যে, নির্বাচন চলাকালে গোলযোগের, ব্যালট পেপার কারচুপির বা নির্বাচন সঠিক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়নি বলে রিপোর্ট বা অভিযোগ উত্থাপিত হলে, উক্ত রিপোর্ট বা অভিযোগের সত্যতা যাচাইপূর্বক কমিশনের ফলাফল বাতিল ও পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক।’ এ ছাড়া আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাসেম [৪৫ ডিএলআর(এডি)(১৯৯৩)] মামলার রায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নিজেদের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজনের ক্ষমতাও কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বিজ্ঞ নির্বাচন কমিশনাররা অবগত আছেন, উচ্চ আদালতের রায়ও আইন এবং তা মানা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। তাই একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমেই কমিটি নূর হোসেন মামলার রায় কার্যকর করতে পারে। আমরা মনে করি, আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে কমিশনের ক্ষমতা হ্রাস সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। আমরা ইতোমধ্যে এক বিবৃতির মাধ্যমে সুজন-এর পক্ষ থেকে এ উদ্যোগের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি এবং নির্বাচনে অনিয়ম ও বল প্রয়োগের মতো ঘটনায় নির্বাচনের দিন কোনো কেন্দ্র বা আসনের ভোট বন্ধ করাসহ তপশিল ঘোষণার পর নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে যে কোনো নির্বাচন স্থগিত ও ফলাফল বাতিলের ক্ষমতা ইসিকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছি।

এমনিতেই ইসি সব রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন ও ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। আরপিওর এই সংশোধনী নির্বাচন কমিশনকে আরও আস্থার সংকটে ফেলবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে একটি ক্ষমতাহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। তা ছাড়া সব দলের অংশগ্রহণে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে কিনা– এটি নিয়ে আমরা যখন সংকটে নিমজ্জিত, তখন এ ধরনের একটি উদ্যোগ এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে, যা কোনো সচেতন নাগরিকের কাম্য হতে পারে না।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন

তথ্য সূত্র: সমকাল  ০৭ জুলাই, ২০২৩