১৯৯৬ সালে বিএনপি বাংলাদেশের সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করে একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে। নব্বইয়ের প্রথমদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং অনেক গড়িমসির পর এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে বিএনপি। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল একটি ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ ফসল। এ বন্দোবস্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের পথই শুধু সুগম করেনি, সব রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার সমসুযোগও সৃষ্টি করেছিল।

২০১১ সালে সংসদে ‘মেজরেটারিয়ান’ পদ্ধতিতে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনী পাশের মাধ্যমে সংবিধানকে নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহার করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। এর ফলে বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ভেঙে যায় এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা সৃষ্টি হয়, যাতে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক এ রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ওপর প্রথম ধাক্কা আসে ২০০৪ সালে, বিএনপির সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী পাশ করে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। দ্বিতীয় ধাক্কা আসে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত বিকল্পগুলো এড়িয়ে বিএনপির রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার ফলে। পরবর্তী ধাক্কা আসে ২০১০ সালের ১০ মে, আপিল বিভাগের এক ‘সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত’ আদেশের হাত ধরে। ওই আদেশে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত উপেক্ষা করে, সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী ‘ভবিষ্যতের জন্য’ অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন, যদিও হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ এর আগে সংশোধনীটিকে সাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিলেন। তবে ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার খাতিরে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকরা পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে হওয়ার পক্ষে মত দেন। একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে বিচারপতিদের বাদ দেওয়ার এখতিয়ার সংসদের ওপর ছেড়ে দেন।

একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙ্গিয়ে বিচারপতি খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি করা হলে তিনি আপিল দায়েরের প্রায় ছয় বছর পর ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করেন এবং অবসর গ্রহণের আট দিন আগে, মাত্র দশ দিনের শুনানির ভিত্তিতে বিভক্ত আদেশটি দেন। বিভক্ত আদেশটি সমর্থনকারী অন্য তিনজন বিচারপতিকেও পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি করা হয়, যার মধ্যে একজনকে আবার প্রধান বিচারপতি করা হয় আরেকজন বিচারপতিকে ডিঙ্গিয়ে। এর ফলে প্রধান বিচারপতি এবং সরকারের মধ্যে এক ধরনের যোগসাজশ ছিল বলে অনেকের মনে ধারণা জন্মে (অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক, ‘পলিটিক্স অব আনকনস্টিটিউশনাল অ্যামেন্ডমেন্টস,’ ডিও আই: ১০)। বিচারপতি হকের সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রণয়নের ক্ষেত্রে আত্মস্বার্থ ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ আছে, কারণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে তিনিই হতেন এর প্রধান উপদেষ্টা।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১০ সালের ২১ জুলাই সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে নবম জাতীয় সংসদ ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করে, যার ১২ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা। এ কমিটি একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতা, সম্পাদক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ মোট ১০৪ জনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখেই ২০১১ সালের ২৯ মে সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত প্রস্তাব করে। পরের দিন কমিটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে এ সুপারিশ বদলে যায়। পরে ৩১ মে প্রধানমন্ত্রী একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে এবং পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে, এ ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তী দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে (প্রথম আলো, ১ জুন ২০১১), যা সঠিক নয়।

এরপর ৩০ জুন ১৫ সদস্যের সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সুপারিশকে উপেক্ষা করে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৪ মাস আগে পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করা হয়। এটি ছিল ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে স্বার্থপ্রণোদিত একটি সিদ্ধান্ত, যার মাধ্যমে সংসদকে বহাল রেখে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। প্রসঙ্গত, ক্ষমতাসীন দলের প্রধানই হবেন নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা এবং তার মন্ত্রিসভার অধীনেই থাকবেন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গবেষক আদিবা আজিজ খানের মতে, ‘বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ এবং ভোটারদের বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সংসদে তার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী দুই জাতীয় নির্বাচনের সময়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল থাকার আদালতের নির্দেশ অমান্য করেছে।’ (দ্য পলিটিক্স অব কনস্টিটিউশনাল অ্যামেন্ডমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল রিভিউ অব ল, ২০১৫)।

পঞ্চদশ সংশোধনীর সাংবিধানিকতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের ‘উইল’ বা ‘অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি,’ তাই তাদের সম্মতি ছাড়া এটির সংশোধন অনভিপ্রেত। আমাদের মূল সংবিধানে না থাকলেও পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এতে গণভোটের বিধান অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীকালে অবশ্য উচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন। তবে ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী পাশের সময়ে গণভোটের বিধানটি আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ছিল, কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমঝোতার ভিত্তিতে ১৯৯১ সালে গৃহীত দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটি যুক্ত হয়েছিল। ফলে পঞ্চদশ সংশোধনী হলো একটি অসাংবিধানিক সংশোধন, কারণ এটি পাশের আগে গণভোটের আয়োজন করা হয়নি।

পঞ্চদশ সংশোধনীটি পাশ হওয়ার আগে এটি নিয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্কও হয়নি। সাধারণত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, বিশেষত সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সুচিন্তিত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। কারণ গণতান্ত্রিক চর্চায় আলাপ-আলোচনা এবং ঐকমত্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল ভিত্তি। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী পাশের ক্ষেত্রে সংসদ ও সংসদের বাইরে কোথায়ও সত্যিকারার্থেই কোনোরূপ সুচিন্তিত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়নি। যদিও বিএনপিকে বিশেষ সংসদীয় কমিটির জন্য একটি নাম প্রস্তাব করতে বলা হয়েছিল, তারা নাম প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে এবং সংশোধনী পাশের সময়ও সংসদে তারা অনুপস্থিত ছিল। অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীতে প্রধান বিরোধী দলের কোনোরূপ সম্পৃক্ততা ছিল না। এমনকি সত্যিকারার্থে, সংসদীয় কমিটির ১৫ সদস্যেরও সমর্থন ছিল না, যারা পূর্বে সর্বসম্মতভাবে এটি বহাল রাখার সুপারিশ করেছিল।

সংসদীয় কমিটি কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখেই সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর বদলে যাওয়া নিঃসন্দেহে ‘সেপারেশন অব পাওয়ারস’ বা সংবিধানের ক্ষমতা পৃথকীকরণের নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়াও পঞ্চদশ সংশোধনীর ৭ক অনুচ্ছেদ সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে অসংশোধনযোগ্য করার ফলে এগুলো ‘বেসিক স্ট্রাকচার’ বা মৌলিক কাঠামোর মর্যাদা পায়, কারণ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংসদ কর্তৃক অসংশোধনযোগ্য- শুধুমাত্র গণপরিষদ এটি সংশোধন করতে পারে। এভাবে মৌলিক কাঠামোর সম্প্রসারণ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো তত্ত্বেরই লঙ্ঘন। উপরন্তু সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলামের মতে, ‘এক সংসদ আরেক সংসদের হাত-পা বেঁধে দিতে পারে না,’ কারণ সংবিধান সংশোধন সংসদের অধিকারের অন্তর্ভুক্ত (কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ, পৃ. ৩১)।

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বাতিলের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করে প্রদত্ত আমাদের উচ্চ আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশ ও পূর্ণাঙ্গ রায়ের সংবিধানিক বৈধতা নিয়ে নানান মত রয়েছে। সংক্ষিপ্ত আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে তা পরবর্তী দুই মেয়াদের জন্য জীবিত রাখা হয়েছে, যা মাহমুদুল ইসলামের ভাষায়, আইনের শাসন ও ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থি। তার মতে, ‘একটি নিন্দিত ব্যবস্থাকে আগামী দুই সংসদ নির্বাচনের জন্য জিয়ে রেখে আপিল বিভাগ বিচারিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আইনসভার সংবিধান প্রদত্ত দায়িত্ব পালনের ওপর হস্তক্ষেপ করেছেন, যা সুপ্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক আইনশাস্ত্র, আইনের শাসন ও ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থি।’ এছাড়াও বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সংসদীয় অনুমোদনের শর্ত জুড়ে দিয়ে তার চূড়ান্ত রায়কে পরিবর্তন করেছেন, যা বিচারপতি আব্দুল মতিনের ভাষায় ‘আদালতের সাথে জালিয়াতি’ এবং পেশাগত আচরণবিধি লঙ্ঘনের সমতুল্য।

পরিশেষে, রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির জেরে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে পরপর দুটি ব্যর্থ নির্বাচন আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত হয়। ভবিষ্যতে আরেকটি ব্যর্থ নির্বাচন জাতি হিসাবে আমাদের জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সুতরাং নির্বাচন কমিশন, আমলাতন্ত্র এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের আরেকটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে, যা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে অপরিহার্য পূর্বশর্ত।

ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক

তথ্য সূত্র: যুগান্তর  ০২ জুন, ২০২৩