নির্বাচনে জনমতের স্বচ্ছ প্রতিফলনের জন্য তিনটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। এটি মাত্র এক দিনের বিষয় নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য নির্বাচনের প্রক্রিয়াগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১. নির্বাচনী আইনের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াগুলো নির্ধারিত হয়। আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে আইনি কাঠামোকে আরও যুগোপযোগী করা হয়। ২. নির্বাচনী প্রক্রিয়াগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। যেমন– নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী ভূমিকা। ৩. পুরো নির্বাচনে একটি সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজন একটি সাংবিধানিক কাঠামো। যেমন, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে নির্বাচনে সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল, যা বড় দলগুলোর জন্য নির্বাচনে জেতার সমসুযোগ সৃষ্টি করেছিল।

মূলত দলগুলোর মধ্যে একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কারণে এই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ভেঙে পড়ে এবং সমতল ক্ষেত্রটি আবার অসমতল হয়ে পড়ে। তাই নির্বাচনী আইনের সংস্কার, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং সমসুযোগ সৃষ্টিকারী সাংবিধানিক কাঠামো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য, যার মাধ্যমে জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটে।  

নতুন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত না হলে নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার সম্ভাবনাই ক্ষীণ। আর নির্বাচন যদি প্রতিযোগিতামূলক না হয়, তাহলে এটিকে নির্বাচন বলা যায় না। নির্বাচন হলো বিকল্পের মধ্য থেকে বেছে নেওয়ার অধিকার, ক্ষমতা ও সুযোগ। তাই নির্বাচনে ভোটারদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প  প্রার্থী না থাকলে ভোটাদের বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে না এবং সত্যিকার অর্থে নির্বাচন হয় না। এতে জনগণের সম্মতির তথা গণতান্ত্রিক শাসনও প্রতিষ্ঠিত হয় না।

কয়েকদিন আগে ৩০ জন সাংবাদিকের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আমি একটি ছোট নিরীক্ষা পরিচালনা করেছিলাম। পান করার জন্য তাঁদের এক গ্লাস মিনারেল ওয়াটার আর এক গ্লাস ট্যাপের পানি মধ্য থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিলে কেউই ট্যাপের পানি বেছে নেননি। পরবর্তী সময়ে তাঁদের এক গ্লাস সিদ্ধ পানি ও এক গ্লাস ট্যাপের পানির মধ্য থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিলে আবারও কেউই ট্যাপের পানি নিতে রাজি হননি। এর পর মিনারেল ওয়াটার, সিদ্ধ পানি ও ট্যাপের পানি থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিলে কয়েকজন মিনারেল ওয়াটার, অন্য কয়েকজন সিদ্ধ পানি বেছে নিলেও, আবারও কেউই ট্যাপের পানি নেননি। অর্থাৎ, বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প থাকলেই তাদের মধ্য থেকে ‘ভোটারদের’ বেছে নেওয়ার বা ‘ইলেক্ট’ করার সুযোগ থাকে। উপরোক্ত উদাহরণে মিনারেল ওয়াটার সিদ্ধ পানির বিকল্প হতে পারে, কিন্তু ট্যাপের পানি এর কোনোটিরই বিকল্প হতে পারে না। অর্থাৎ বিএনপি সাধারণত আওয়ামী লীগের বিকল্প হতে পারে, কিন্তু অন্য কোনো দল নয়।

আমি আগেই বলেছি, নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ও নতুন করে নির্বাচন করার যে ক্ষমতা কমিশনের ছিল, আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব করার মাধ্যমে তা আত্মঘাতী হতে পারে। কারণ, এই ক্ষমতা চাওয়ার দরকার ছিল না, ক্ষমতা তাদের আছেই [নূর হোসেন বনাম মো. নজরুল ইসলাম, ৪৫বিএলসি (এডি)(২০০০)] । মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এখন তো মনে হয় কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, যদি গাইবান্ধা-৫ এর উপনির্বাচন দেখি, গাইবান্ধা নির্বাচনে কমিশন ৫১টি কেন্দ্রে নির্বাচন স্থগিত করেছে, না পুরো নির্বাচন বাতিল করেছে তা আমরা নিশ্চিত নই। এখানে একটি অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। যদি স্থগিত করত তাহলে শুধু ৫১টি কেন্দ্রে পুনর্ভোট করলেই হতো। কিন্তু তারা পুরো নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন করেছে। যদিও কমিশন যা করেছে তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, বাতিল করে পুনর্ভোট করলে নতুন তপশিল ঘোষণা করা এবং অন্যদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। নতুন তপশিল ঘোষণা না করে গাইবান্ধার পুরো নির্বাচন দেওয়ায় তা নিয়ে বৈধতার প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। আরপিও সংশোধনের ফলে এখন কমিশন আর গাইবান্ধার মতো ফলাফল বাতিল করতে পারবে না বলে আমাদের মনে হয়।    

গণমাধ্যম হতে পারে নির্বাচন কমিশনের চোখ-কান। নির্বাচন কমিশন যদি সতিকার অর্থে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়, তাহলে গণমাধ্যম তাদের সহায়ক শক্তি হতে পারে। কিন্তু যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তাতে সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনেই শুধু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে তাই নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের পথেও বাধা সৃষ্টি হবে। নির্বাচন কমিশন কোন স্বার্থে সাংবাদিকদের ওপর এই বিধি নিষেধ আরোপ করেছে, তা আমাদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।

নির্বাচনকালীন সরকার এমন হতে হবে যা সবার জন্য সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। কারও প্রতি কোনো পক্ষপাত করবে না। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনের সমতল ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সমতল ক্ষেত্রকে অসমতল করে দেওয়া হয়েছে। এই সংশোধনীর ফলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর কোনোটিই সুষ্ঠু হয়নি। কারণ, ক্ষেত্রটা ছিল অসমতল। অর্থাৎ, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে। অতএব, নির্বাচনকালীন সরকার এমন একটি সরকার হতে হবে যেটি প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে সমতল ক্ষেত্রে প্রস্তুত করবে। কেউ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সর্বোপরি, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।

লেখক: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

তথ্য সূত্র: সমকাল  ২৭ মে, ২০২৩