রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে বিদায় নিচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দুদকের সাবেক কমিশনার মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছে। একক প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচন কমিশন তাঁকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি গেজেট জারি করেছে। এপ্রিল মাসে নতুন রাষ্ট্রপতি শপথ নেবেন।

এখন মোঃ সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কারণ দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ধারা ৯ অনুযায়ী ‘কর্মাবসানের পর কোনো কমিশনার প্রজাতন্ত্রের কার্যে কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’ প্রশ্ন হলো- আমাদের রাষ্ট্রপতি কি প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত?

এখানে ইস্যু হলো রাষ্ট্রপতির পদ; ব্যক্তি নয়। তাই ব্যক্তি নির্বাচিত কি অনির্বাচিত বা তিনি বেতন-ভাতা বা সম্মানী পান, তা অপ্রাসঙ্গিক, যদিও কেউ কেউ এসব যুক্তি উত্থাপন করছেন। এ ক্ষেত্রে ‘নির্বাচন’ শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারেও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কারণ, সত্যিকার অর্থে নির্বাচন হলো বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া। মোঃ সাহাবুদ্দিনের ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প প্রার্থীই ছিলেন না।

আমাদের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত লাভজনক পদের কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলামের মতে, ‘লাভজনক পদ এমন পদ, যা থেকে আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায় … এ কথা স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, সব লাভজনক পদের ক্ষেত্রেই অযোগ্যতা প্রযোজ্য নয়; অযোগ্যতার জন্য পদ হতে হবে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত লাভজনক পদ’ (কনস্টিটিউশনাল ল, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ. ৪৬৪)।

রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত কিনা- ইস্যুটি সুরাহার ক্ষেত্রে আমাদের সংবিধানের পাঁচটি অনুচ্ছেদ- অনুচ্ছেদ ৪৮(৪), ৫০(৪), ৬৬(৩), ৬৬(৪) এবং ১৪৭ প্রাসঙ্গিক। এ ছাড়া কিছুটা প্রাসঙ্গিক আবু বক্কর বনাম বিচারপতি সাহাবুদ্দীন (৪৯ ডিএলআর) এবং রুহুল কুদ্দুস বনাম এম এ আজিজ (৬০ ডিএলআর)।

অনুচ্ছেদ ৪৮(৪)(খ) বলছে- ‘কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হইবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি- … সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য না হন।’ অনুচ্ছেদ ৫০(৪) বলছে- ‘রাষ্ট্রপতি তাঁহার কার্যভারকালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য হইবেন না …।’ অনুচ্ছেদ ৬৬(২) বলছে- ‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না; যদি (চ) আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করিতেছেন না, এমন পদ ব্যতীত তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন …।’ অনুচ্ছেদ ৬৬(৩) বলছে- ‘এই অনুচ্ছেদের (সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্যতা সম্পর্কিত) উদ্দেশ্য সাধনকল্পে কোনো ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী হইবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।’

অনুচ্ছেদ ৪৮(৪), ৫০(৪০), ৬৬(২) এবং ৬৬(৩) একত্রে পড়লে যা দাঁড়ায় তা হলো, কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্য হবেন না যদি তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য না হন। প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে নিয়োজিত ব্যক্তি সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য; যদি আইনের দ্বারা তাঁর এ অযোগ্যতা দূর না করা হয়। প্রসঙ্গত, ৬৬(২), ৬৬(৩) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিসহ সাতজন ব্যক্তির সংসদ সদস্য হওয়ার এ অযোগ্যতা দূর করা হয়েছে।

অন্যভাবে বলতে গেলে, রাষ্ট্রপতি যদি প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে নিয়োজিত ব্যক্তি না হতেন তা হলে ৫০(৪) অনুচ্ছেদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন হতো না। যেহেতু তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত, তাই অন্যদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতিকেও সংবিধানের ৬৩(৩) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি যদি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত না হতেন, তাহলে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য আমাদের সংবিধান প্রণেতাগণ তাঁকে অব্যাহতি দিতেন না। তাই রাষ্ট্রপতির পদ নিঃসন্দেহে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত একটি লাভজনক পদ।

এবার দুটি উচ্চ আদালতের রায়ের দিকে নজর দেওয়া যাক, যেগুলো ১৪৭(৪) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা প্রদান করেছে। আবু বক্কর সিদ্দিক বনাম বিচারপতি সাহাবুদ্দীন মামলায় বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি মোঃ আবদুল মতিন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ১৯৯৬ সালে রায় দেন- ‘রাষ্ট্রপতির পদ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত লাভজনক পদ নয়।’ ২০০৭ সালে রুহুল কুদ্দুস বনাম বিচারপতি এম এ আজিজ মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের (বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এসএম জিয়াউল করিম সমন্বয়ে গঠিত আরেকটি) বেঞ্চ রায় দেন যে, ১৪৭(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার অথবা ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী অথবা উপমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, নির্বাচন কমিশনার এবং সরকারি কর্ম কমিশনারের পদসমূহ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত পদ।

এটি সুস্পষ্ট যে, এ দুটি রায় পরস্পরবিরোধী; কিন্তু এগুলো হাইকোর্টের বিভাগের রায় এবং এগুলো আপিল বিভাগ পর্যন্ত যায়নি। তাই চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেনি। এ ছাড়া পরবর্তী ঘটনাবলি এ দুটি রায়কে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলেছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১০ সালের ২১ জুলাই তারিখে নবম জাতীয় সংসদ উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করে। আইন মন্ত্রণালয় ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধান নতুন করে মুদ্রণ করে, যাতে এ দুটি রায় প্রতিফলিত হয়নি। এ ছাড়া বিশেষ সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ৩০ জুন আমাদের সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সংশোধন করা হয়, যাতেও এ দুটি রায় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তাই রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোঃ সাহাবুদ্দিনের নিয়োগের সঠিকতা বিরাজমান সাংবিধানিক বিধানের আলোকেই বিবেচনা করতে হবে।

পরিশেষে, সংবিধানের ৪৮(৪), ৫০(৪), ৬৬(২) ও ৬৬(৪) অনুচ্ছেদ একত্রে এবং অনুচ্ছেদ ১৪৭ পৃথকভাবে পড়লে এটি সুস্পষ্ট যে, ১৪৭(৪) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত রাষ্ট্রপতিসহ ১১টি পদ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত লাভজনক পদ। এ থেকে পাঠক নিজেই উপসংহারে পৌঁছতে পারবেন দুদকের সাবেক কমিশনার হিসেবে মোঃ সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন কিনা। এ প্রসঙ্গে পাঠক আরও বিবেচনায় নিতে পারেন ১৪৭ অনুচ্ছেদের ‘কতিপয় পদাধিকারীর পারিশ্রমিক প্রভৃতি’ অংশটি। উল্লিখিত পারিশ্রমিক, বিশেষ-অধিকার ও কর্মের অন্যান্য শর্ত সংসদ আইনের দ্বারা নির্ধারণ করেন এবং রাষ্ট্রের সম্মিলিত তহবিল থেকে তাঁরা বেতন-ভাতা পান। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত বলেই এসব বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা তাঁদেরকে দেওয়া হয়।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক

তথ্য সূত্র: সমকাল | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩