সংবিধান নিয়ে বিতর্কের যেন শেষ নেই। নব্বইয়ের প্রথমার্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে বিএনপি সে দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, এটি সংবিধানে নেই।
এখন বিএনপির এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ শুধু এটি সংবিধানে নেই বলেই ক্ষান্ত হয় না, বরং আগ বাড়িয়ে আরও বলে যে সংবিধান থেকে একচুলও তারা নড়বে না। এ রকম এক প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কোন সংবিধানের প্রতি তাদের এমন অনড় অবস্থান? এটি কার সংবিধান?
জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সৃষ্টি হলেও, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে শুরু থেকেই আমাদের ক্ষমতাসীনেরা অপারগতা প্রদর্শন করে আসছে। এই অপারগতা দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল একটি রাজনৈতিক সমঝোতা। অন্যভাবে বলতে গেলে, একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির কারণে সর্বস্তরে যে সর্বগ্রাসী দলীয়করণ হয়েছে, তার ফলে আমাদের নির্বাচনীব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং আমাদের দেশে পরপর দুটি ব্যর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে
কারণ, এর দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং অনেক গড়িমসির পর তা মেনে নিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয় বিএনপি। এ বন্দোবস্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের পথই শুধু সুগম করেনি, এর মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার সম-সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।
এই বন্দোবস্তের ওপর প্রথম ধাক্কা আসে ২০০৪ সালে, বিএনপি সরকারের আমলে, সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী পাস করে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। দ্বিতীয় ধাক্কা আসে ২০১০ সালের ১০ মে তারিখে আপিল বিভাগের এক সংক্ষিপ্ত আদেশের হাত ধরে। এ আদেশে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ‘প্রসপেকটেভলি’ বা ভবিষ্যতের জন্য, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন, যদিও এর আগে হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানসম্মত বলে রায় দিয়েছেন।
তবে ১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তটি ভেঙে দেওয়া হয় ‘মেজরিটারিয়ান পদ্ধতিতে’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রায় ১৫ মাস আগে, ২০১১ সালের ৩০ জুন তারিখে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী একতরফাভাবে পাসের মাধ্যমে, যা আইনকে অস্ত্রে পরিণত করেছে।
২০১০ সালের ২১ জুলাই সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে নবম জাতীয় সংসদ ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করে, যার ১২ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগের সদস্য। এই বিশেষ সংসদীয় কমিটি একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতা, সম্পাদক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ মোট ১০৪ জনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে, তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখেই ২০১১ সালের ২৯ মে সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত প্রস্তাব করে।
এর পরদিন কমিটির সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যার পর কমিটির সুপারিশ বদলে যায় এবং কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়েই সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করে। প্রসঙ্গত, ৩১ মে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয় যে আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগবে (প্রথম আলো, ১ জুন ২০১১), যা সঠিক নয়।
এটি সুস্পষ্ট যে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে বিশেষ সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সুপারিশ উপেক্ষা করে, আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশের একটি বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এবং আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রায় ১৫ মাস আগে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এটি ছিল একটি স্বার্থপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত। কারণ, এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে একই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়।
পঞ্চদশ সংশোধনীর ‘লেজিটিমেসি’ বা গ্রহণযোগ্যতা এবং সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। সংবিধান বাংলাদেশের ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি,’ তাই তাদের সম্মতি ছাড়া এটির সংশোধন অগ্রহণযোগ্য।
বাহাত্তরের সংবিধানে গণভোটের বিধান না থাকলেও, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যদিও পরবর্তী সময় উচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন। তবে গণভোটের বিধানটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমঝোতার মাধ্যমে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯১ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের আগে গণভোটের আয়োজন করে জনগণের সম্মতি নেওয়া হয়নি।
পঞ্চদশ সংশোধনী সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ অনেকগুলো কারণে। প্রথমত, গণভোটের আয়োজন না করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের আগের বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ লঙ্ঘন করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিশেষ সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নাকচ করে দেওয়া ‘সেপারেশন অব পাওয়ার্স’ বা ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতির লঙ্ঘন। তৃতীয়ত, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে সংশোধন অযোগ্য করা হয়। একমাত্র সংবিধানের ‘বেসিক স্ট্রাকচার’ বা মৌলিক কাঠামে অসংশোধনযোগ্য।
তাই সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশকে অসংশোধনযোগ্য করে পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রণেতারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো তত্ত্বই লঙ্ঘন করেছেন। সংবিধান সংশোধনের ওপর এমন নিষেধাজ্ঞা আরেকভাবেও সংবিধানের লঙ্ঘন।
পরিশেষে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির কারণে সর্বস্তরে যে সর্বগ্রাসী দলীয়করণ হয়েছে, তার ফলে আমাদের নির্বাচনীব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং আমাদের দেশে পরপর দুটি ব্যর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আরেকটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সৃষ্টি না হলে আমাদের পরবর্তী নির্বাচনও বিতর্কিত হতে বাধ্য, যা জাতি হিসেবে আমাদের এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
তথ্য সূত্র: প্রথম আলো | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩