একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে শক্তি, সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে আমাদের ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’, যাতে বঙ্গবন্ধুর ‘জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে (র)…স্বাধীনতার ঘোষণা’র অনুমোদন দেওয়া হয়।

একই সঙ্গে এতে ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা’ করা হয়। অর্থাৎ জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার ইত্যাদি হলো বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনের আমাদের প্রথম সংবিধান স্বীকৃত আদর্শ ও মূল্যবোধ।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আদর্শ ও মূল্যবোধগুলোই পরিমার্জিত রূপে আবির্ভূত হয় ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আর এসব অঙ্গীকারই মূলত মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক-নাগরিক অধিকার ও আইনের শাসনের উৎস, যার অনেকগুলোকেই আমাদের সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদে আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্র পরিচালনার এই চার মূলনীতি আমাদের সংবিধানের ৯, ১০, ১১ ও ১২ অনুচ্ছেদে আরও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অনুচ্ছেদ ৯-এ বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি বলে আখ্যায়িত করা হয়। অনুচ্ছেদ ১০-এ সব শোষণ-বঞ্চনার অবসানের লক্ষ্যে সাম্যবাদী সমাজ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়। অনুচ্ছেদে ১১-তে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করা হয়, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’

অনুচ্ছেদ ১২-তে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতার অবসান, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা প্রদান ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার না করার এবং কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাদের ওপর নিপীড়ন বিলুপ্ত করার অঙ্গীকার করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা ও সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলোর মধ্যে অনেকগুলো সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার আজও বহুলাংশে অপূর্ণই রয়ে গেছে। গত ৫০ বছরে কোনো সরকারই এগুলো অর্জনে তেমন আন্তরিকতা প্রদর্শন করেনি।

তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের গত এক দশকের বেশি সময়ের শাসনকালেই এগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপর্যস্ত হয়েছে আমাদের ভোটাধিকার ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকার। ভিন্নমত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে বেছে নেওয়া হয়েছে দমন-পীড়নে পথ। দলীয়করণ ও অদক্ষতার কারণে সাংবাধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যকারিতা হারিয়েছে। এসব অবনতি জাতি হিসেবে আমাদের অনেকটাই পথহারা করে ফেলেছে। যার পরিণতিতে বাংলাদেশের কপালে আজ জুটেছে ‘কর্তৃত্ববাদী’ (সুইডেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স বা আইডিইএ এর প্রতিবেদন) রাষ্ট্রের তকমা।

এমনি পরিস্থিতিতেকর্তৃত্ববাদ’-এর তকমা ঘোচাতে এবং অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে প্রয়োজন ছিল সরকারের নমনীয়তা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা এবং অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার পদক্ষেপডেমোক্রেটিক ডেফিসিটবা গণতন্ত্রের ঘাটতি গভর্ন্যান্স ফেইলিউরবা সুশাসনের অভাব পূরণে কার্যকর উদ্যোগ কিন্তু ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে প্রতীয়মান হয়, সরকার ক্ষমতাসীন দল এখন চরম কঠোর অবস্থানে

আমাদের পথ হারানো জাতিতে পরিণত হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং হানাহানি। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করলেও আজ আমরা নিজেরাই যেন একে অপরের চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছি।

আমাদের রাজনীতিবিদেরা, বিশেষত আমাদের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। ২০০৪ সালে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনা ছিল এই রাজনীতির এক ভয়াবহ ও নগ্ন প্রকাশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই রাজনীতি থেকে আমরা সরে আসতে পারিনি। আমরা দেখছি নানা কৌশলে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারালয়কে ব্যবহার করে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে।

বস্তুত রাজনীতিকে এখন ‘ব্লাড-স্পোর্টসে’ পরিণত করা হয়েছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতি হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও পরিচয়ভিত্তিক ঘৃণা, বিভাজন ও হানাহানি আমাদের সমাজে আজ অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বস্তুত রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত বিরোধের কারণে জাতি হিসেবে আমরা যেন বর্তমানে এক স্তূপ বারুদের ওপর দাঁড়িয়ে আছি, যার কিছুটা নিদর্শন আমরা দেখতে পেয়েছি ২০২১ সালের দুর্গাপূজা পালনের সময় কুমিল্লার ঘটনা থেকে। এমনই পরিস্থিতিতে যেকোনো স্বার্থান্বেষী মহল অতি সহজেই বিরাজমান বারুদের স্তূপে জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি ছুড়ে দিয়ে দেশব্যাপী দাবানল সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত হতে পারে।

২০০৮ সালে জাতিকে ‘দিনবদলের’ স্বপ্ন দেখিয়ে—যে স্বপ্নের অংশ ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে দলীয়করণের অবসান—বর্তমান মহাজোট সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এক ভূমিধস বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা, সুশাসনের অভাব এবং চরম অদক্ষতা-অব্যবস্থার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই দিনবদলের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকার ব্যর্থ হয় এবং ‘গণতন্ত্র বনাম উন্নয়নের’ এক অদ্ভুত ও আত্মঘাতী স্লোগান ব্যবহার করে চড়া শর্তে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে চোখধাঁধানো ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল অনেক অবকাঠামো তৈরিতে সরকার মনোনিবেশ করে।

এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ‘ক্রেনিজম’ বা স্বজনতোষণের চর্চা চলে, ফলে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট ও অর্থ পাচার বেসামাল পর্যায়ে পৌঁছায়। এমন ভ্রান্ত উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে উন্নয়ন তথা প্রবৃদ্ধির হার বাড়লেও ‘উন্নতি’র পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে অবনতিই হয়েছে। সমাজে বৈষম্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটলেও সাধারণ জনগণের অবস্থার ও অবস্থানের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেনি। বরং চরম অব্যবস্থা ও দায়বদ্ধহীনতার কারণে অর্থনীতি সংকটের মধ্যে পড়েছে, যা করোনাভাইরাস মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধেরও ফলে বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।

এমনি পরিস্থিতিতে ‘কর্তৃত্ববাদ’-এর তকমা ঘোচাতে এবং অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে প্রয়োজন ছিল সরকারের নমনীয়তা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা এবং অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার পদক্ষেপ। ‘ডেমোক্রেটিক ডেফিসিট’ বা গণতন্ত্রের ঘাটতি ও ‘গভর্ন্যান্স ফেইলিউর’ বা সুশাসনের অভাব পূরণে কার্যকর উদ্যোগ। কিন্তু ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে প্রতীয়মান হয়, সরকার ও ক্ষমতাসীন দল এখন চরম কঠোর অবস্থানে।

অধিকাংশ নাগরিক ও উন্নয়ন সহযোগীদের সুষ্ঠু নির্বাচন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, আইনের শাসন ও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন রোধের দাবি সরকার এমনকি আমলে নিতেও অসম্মত।

বরং এসব দাবি যারা করছে, সরকার তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং দলের সুবিধাভোগকারী অংশকে সঙ্গে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। মনে হয় যেন এতে জাতীয় পার্টিকেও সঙ্গে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। সরকারের চিহ্নিত প্রতিপক্ষের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক দল, দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন, গণমাধ্যম, এমনকি অনেক বিদেশি দূতাবাস।

সরকারের অনেক সমর্থকই মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি আছে এবং তিনি তা ব্যবহার করে বর্তমান পরিস্থিতি সামলাতে পারবেন। তবে আমাদের বর্তমান সমস্যা অনেক কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণ ও বহুমুখী। উদাহরণস্বরূপ, অর্থনৈতিক সমস্যা পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই, যা অতি সহজেই জটিল আকার ধারণ করতে পারে। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতাবদলের পথ পুরোপুরি রুদ্ধ হয়ে গেলে অনিয়মতান্ত্রিক, এমনকি সহিংসভাবে তা ঘটতে বাধ্য, যা

আর সহিংসভাবে ক্ষমতার রদবদল হলে কেউই নিরাপদে থাকবে না এবং ইতিমধ্যে অর্জিত ‘উন্নয়ন’ও টিকে থাকবে না, যে পরিস্থিতি কারও জন্যই কাম্য হতে পারে না।

তাই আমরা মনে করি, ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বার্থে আমাদের জন্য এখন কাঙ্ক্ষিত পথ হলো শান্তি-সম্প্রীতি ও সমঝোতার পথ—পথ হারানো জাতিকে আবার ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনার পথ। আর এ জন্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা ও সাহসিকতা।

ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

তথ্য সূত্র: প্রথম আলো | ১৯ ডিসেম্বর ২০২২