বাংলাদেশের রাজনীতির যেকোনো নিবিড় পর্যবেক্ষকই দ্বিমত করবেন না যে, আমাদের রাজনীতিবিদের অধিকাংশই ক্ষমতার রাজনীতিতে বিভোর। তাঁরা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে বদ্ধপরিকর। যৌক্তিকতা, নৈতিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা এবং জনকল্যাণ তাঁদের অনেকের কাছেই গৌণ বিষয়। এর পরিণতিতেই আমরা আজ এক অগণতান্ত্রিক, কর্তত্ববাদী শাসনব্যবস্থার মধ্যে নিপতিত।

অনেকেরই স্মরণে আছে যে, বহু আন্দোলন ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পর নব্বইয়ে স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন হয়। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলনরত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বামপন্থিদের ৫ দল মিলে এরশাদ-পরবর্তী সরকারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি কীরূপ হবে তার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে, যা ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নামে পরিচিত। ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর ওই তিনটি জোট আলাদা আলাদা সমাবেশে রূপরেখাটি তুলে ধরে। এর ১৫ দিনের মাথায় এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

তিন জোটের রূপরেখার প্রধান দিক ছিল স্বৈরাচার যেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে লক্ষ্যে রাজনীতিবিদদের দৃঢ় অবস্থান। ছিল নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। ওই রূপরেখায় জাতীয় সংসদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটারদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার বিধান নিশ্চিত করে কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। এছাড়াও স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে আবারও গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল রূপরেখায়।

আরও কিছু ধারা-উপধারায় স্বাধীন বিচার বিভাগ ও বেতার-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠাসহ আরও কিছু অঙ্গীকারও এতে তুলে ধরা হয়েছিল। এছাড়া এরশাদের পতনের পর ‘রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আচরণবিধি’ নামে একটি অঙ্গীকারনামায় তাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন। সেই অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছিল, ‘আমাদের তিনটি জোটভুক্ত দলসমূহ ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকবে। আমাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় প্রদান করবে না। এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করবে … স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের চিহ্নিত সহযোগী ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের আমাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহে স্থান না দেওয়ার জন্য আমাদের ইতোপূর্বে প্রদত্ত ঘোষণা কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে।’

তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়নের ৩২ বছর পর আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করলে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে সেই রূপরেখার প্রায় পুরোটাই আমরা বিসর্জন দিয়েছি। এই বিসর্জন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে রূপরেখা প্রণয়নের অব্যবহিত পর থেকেই।

১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটেছে বলা হলেও বিএনপি সরকারের আমলে গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী সংস্কৃতির খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৯৩ সালের দিকে মাগুরা ও মিরপুরে দুটি উপনির্বাচনে সেটি প্রমাণিত হয়। আসন দুটিতে ক্ষমতাসীন বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এর পরপরই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্যান্য বিরোধী দল সংবিধানে স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের দাবি তোলে এবং ইস্যুটি নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। বিএনপি সরকার অবশ্য সে দাবি মানেনি। ফলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয় এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা। সে সময় ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ রক্ষার জন্য ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় একতরফা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ ‘নির্বাচন’, যদিও প্রয়োজনীয় ও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী না থাকলে তাকে নির্বাচন বলাই সমীচীন নয়। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে নতুন সংসদ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা এবং পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় বিএনপি। এরপর একই বছরের ১২ জুন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

দীর্ঘ ২৩ বছর পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে, যার ফলে বাংলাদেশ প্রথম বারের মতো টিআইবির দুর্নীতির সূচকে প্রথম হয়। ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলে সন্ত্রাসের গডফাদার। স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভোটের রাজনীতিকে আমলে নিয়ে এরশাদকে নিজেদের জোটভুক্ত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

পরবর্তীকালে ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু আগের সরকারের মতো বিএনপিও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ ওঠে। তবে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগ পিছিয়ে থাকেনি – তারাও খেলাফত মজলিশের সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করে, প্রবল প্রতিবাদের মুখে যা পরে বাতিল করতে বাধ্য হয়।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর ভরসা না রেখে এ সময়ে বিএনপি কৌশলে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা চালায়। পছন্দের লোককে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগদানের জন্য বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ায়। এরপর ভোটার তালিকায় ত্রুটি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে বিরোধী দলসমূহের সহিংস আন্দোলনের মুখে যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হতে পারেনি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সংবিধান নির্দেশিত পন্থায় অর্থাৎ বিচারপতিদের মধ্য থেকে কাউকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে না পারার অজুহাতে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টা পদে আসীন হন। এর মাধ্যমে বিতর্কিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা।

সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে তথা ১/১১ এর ঘটনায় ড. ইয়াজউদ্দিন পদত্যাগ করলে দেশ পরিচালনার ভার নেয় সেনা-সমর্থিত আরেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনা, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও নির্বাচন আচরণবিধিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে ২০০৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নবম জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করে, যার মধ্য দিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী জোট। দেশের মানুষ আশা পোষণ করেছিল, এবার রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন হবে, ‘দিনবদলের’ ইশতেহারের আলোকে দেশ পরিচালিত হবে, প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং দলীয়করণের অবসান হবে তথা এক উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারার প্রবর্তন ঘটবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জনগণের সে আশা পূরণ হয়নি।

২০১১ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বিচারপতি খায়রুল হক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলায় একটি সংক্ষিপ্ত, বিভক্ত আদেশ দেন। এর মাধ্যমে আপিল বিভাগের বিচারকদের ৪:৩-এর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে অবসর গ্রহণের প্রায় ১৫ মাস পর বিচারপতি খায়রুল হক ৭৪৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণ অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপরীতে ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতিতে সংসদের মেয়াদ শেষে প্রথাগতভাবে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দেন, যদিও সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ‘অনির্বাচিত’।

দুর্ভাগ্যবশত রায় প্রদানকালে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিগণ বিবেচনায় নেননি যে, নানা ধরনের অনিয়মের কারণে অতীতের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণ ও তাদের সার্বভৌমত্ব খর্ব করা হয়েছিল, যার প্রতিকারের লক্ষ্যেই প্রবল গণআন্দোলনের মাধ্যমে এবং রাজনীতিবিদদের এক ধরনের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল জনগণের সম্মতির শাসন ও তাদের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উদ্ভাবিত একটি মীমাংসিত বিষয়। প্রসঙ্গত, আপিল নিষ্পত্তির সময় আদালত ‘অ্যামিকাস কিউরি’ হিসেবে আটজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর বক্তব্য শোনেন।

আটজন বিশেষজ্ঞের মধ্যে সাতজনই – জনাব আজমালুল হোসেন কিউসি ছাড়া – তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বৈধ এবং তা অব্যাহত রাখার পক্ষে মতামত দেন। বিচারপতি খায়রুল হক নিজেই তাঁর রায়ে বলেন, অ্যামিকাস কিউরিদের ‘আশঙ্কা নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে দেশে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইতে পারে। তাঁহারা সকলেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাঁহাদের আশঙ্কা আমরা একেবারে অবহেলা করিতে পারি না’ The Constitution (Thirteenth Amendment) Act’s Case, Bangladesh Law Times, সেপ্টেম্বর ২০১২, পৃ. ২০৭)।

লিখিত বক্তব্যে প্রথিতযশা সংবিধান বিশেষজ্ঞ, মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘… দেশের সকল রাজনৈতিক দল ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাসকৃত ত্রয়োদশ সংশোধনী গ্রহণ করিয়াছে; ইহার বিধানের অনুসরণে একাধিক্রমে অনুষ্ঠিত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে দেশের জনগণ অংশগ্রহণ করিয়াছে।

সুতরাং ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের যোগ্যতা বা কার্যকারিতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপন করা বাতুলতা মাত্র'[The Constitution (Thirteenth Amendment) Act’s Case], Bangladesh Law Times,  সেপ্টেম্বর ২০১২, পৃ. ৪০)।

মৃত্যুর আগে রায়টি নিয়ে জনাব ইসলামের সঙ্গে বর্তমান লেখকের কথা হয়। তিনি বিষয়টি নিয়ে চরম হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি ছিল একটি ‘পলিটিক্যাল কেয়েশ্মান’ বা রাজনৈতিক বিষয় এবং বিষয়টিতে নিয়ে আদালতের জড়িত হওয়া ঠিক হয়নি। প্রসঙ্গত, সাংবিধানিক আইনে পলিটিক্যাল কোয়েশ্মান বলে একটি ‘ডকট্রিন’ বা মতবাদ রয়েছে, যা এসেছে মার্কিন বিচার বিভাগ থেকে [লুথার বনাম বোর্ডেন (১৮৪৯)]। এর তাৎপর্য হলো, রাজনীতিবিদদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত বিষয়ে আদালতের মাথা না ঘামানোই শ্রেয়। যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত এক ব্যাপক গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে, জনদাবির মুখে বিএনপি ষষ্ঠ সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করে, তাই এটির ব্যাপারে একটি রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছিল। এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তাও অর্জন করছিল। উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে সারাদেশে এখনও ব্যাপক জনমত বিরাজ করছে, যা একাধিক জরিপে উঠে এসেছে। তা সত্ত্বেও বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের একটি বিভক্ত রায়ের মাধ্যমে এটি বাতিল হয়ে যায়।

বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর বাংলাদেশে যেসব ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে তা আমাদের সবারই জানা। নবম সংসদে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির, যে কমিটিতে আওয়ামী লীগ ও জোট সরকারের সকল জ্যেষ্ঠ নেতারা ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখেই সংবিধান সংশোধন করার সর্বসম্মত সুপারিশ উপেক্ষা করে, চূড়ান্ত রায় লেখার আগেই, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটিকে সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয়। সংসদের এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিচারপতি খায়রুল হকের সংক্ষিপ্ত আদেশকেই অজুহাত হিসেবে দেখানো হয়। প্রসঙ্গত, এর পর যা ঘটেছে, তার সম্ভাবনাও মাহমুদুল ইসলাম অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেছিলেন। তিনি এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হলে বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের কথা বলেছেন।

তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার আরজিও রেখেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর এবং অন্যান্য অ্যামিকাস কিউরির প্রজ্ঞাবান পরামর্শ উপেক্ষা করার বিয়োগান্তক পরিণতি – রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের ব্যাপক অনাস্থা এবং ভোটদানে অনীহা – সবই আমরা পরবর্তী সময়ে স্বচক্ষে দেখেছি এবং এখনও দেখছি! তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনীতির মাঠ। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ দেশের ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দল দশম (২০১৪) জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে, যে নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হন, যদিও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের অনপুস্থিতিতে তা সত্যিকারের নির্বাচনই ছিল না।

২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে দেশের সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে এক ধরনের ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন হলেও, তা প্রতিযোগিতামূলক ছিল না। নির্বাচনের মাঠ ছিল পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে, যে কারণে ঘটেছে মধ্যরাতের ভোটের প্রহসন। একটি পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশনের অধীনে আগামীতেও আমরা আরেকটি জালিয়াতির নির্বাচনের পাঁয়তারা এখন দেখতে পাচ্ছি। অর্থাৎ সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা তো কাটেইনি, বরং তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি, বিশেষত আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদদের কাছে আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল তাঁরা তা পূরণ করতে পারেননি – তাঁরা সার্বভৌম জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারেননি, যে ব্যর্থতার কারণে তাঁরা ইতিহাসের মহানায়ক হতে পারেননি।

বরং আদালতের রায়কে ব্যবহার করে, বিশেষজ্ঞ ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছেন। দলীয় অনুগতদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। ফলে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা আজ ধ্বংসপ্রায়, যার প্রতিফলন দেখেছি আমরা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পর পর দুটি তথাকথিত নির্বাচনে, যার মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার নগ্নভাবে হরণ করা হয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বর্তমানে সংবিধান নির্দেশিত পন্থায় অর্থাৎ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সরকার গঠন প্রক্রিয়া অকার্যকর হয়ে পড়ছে, সংসদ ও রাজনৈতিক মাঠে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এবং সরকার পরিচালনার সর্বস্তরে জবাবদিহিতার অভাব, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও বল প্রয়োগের রাজনীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, গণতন্ত্রের বদলে উন্নয়নতন্ত্রের তত্ত্ব সামনে আনা হয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধির পরিমাপকে আমাদের ‘উন্নয়ন’ হলেও, কাঙ্ক্ষিত ‘উন্নতি’ হয়নি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে, যার ধ্বংসলীলা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই আমাদের চারপাশে।

আর আমরা জানি, দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক কাঠামোতে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে ক্ষমতা ‘দখল’ করলেই হয় না, ক্ষমতায় টিকেও থাকতে হয়। আর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়োজন পড়ে। সে কারণেই দেশি-বিদেশি নানান পক্ষকে অন্যায় ফায়দা দিয়ে সরকার সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে গড়ে উঠেছে বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে রাষ্ট্র আজ, প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ভাষায়, ক্রমাগতভাবে ‘বাজিকরদের’ হাতে চলে যাচ্ছে, যার কারণ চলমান অযৌক্তিক, অনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধবিবর্জিত রাজনীতি।

লেখক: বদিউল আলম মজুমদার
সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক

তথ্য সূত্র: সমকাল  | ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২