গণতান্ত্রিক শাসন আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’। এ ছাড়া আমাদের সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দেওয়া আছে, যা গণতান্ত্রিক শাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার যাত্রা শুরুই হয় নির্বাচনের মাধ্যমে, যাতে জনগণের সম্মতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ।
একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে মুখ্য দায়িত্ব পালন করে থাকে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ছাড়া সরকার তথা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রাজনৈতিক দলের ভূমিকাও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অপরিসীম। পাশাপাশি নাগরিক সমাজের সক্রিয়তাও সুষ্ঠু বা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারে।
সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনেরই দায়িত্ব নির্বাচন পরিচালনা করা। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যেগুলো হলো: (১) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন, (২) সংসদ নির্বাচন, (৩) নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ এবং (৪) ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ। এসব কার্যক্রমে কমিশনের দায়িত্ব হলো ‘তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ’। এসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের অধীনে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই বর্তমান আউয়াল কমিশন যদি নিজের সক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করে, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম হবে।
উল্লিখিত চারটি দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের ‘তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণের’ ক্ষমতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাসেম মামলার রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নির্বাচন কমিশনের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কমিশন আইন ও বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজনও করতে পারে, যে ক্ষমতা সাধারণত নির্বাচিত সংসদের জন্যই নির্ধারিত। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ইসিকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে এরই মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ আরও অনেকগুলো রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন, ২০২২-এ স্বচ্ছভাবে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান থাকলেও বর্তমান কমিশন গঠনের স্বচ্ছতা নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন। ফলে বর্তমান কমিশনের প্রতি গুরুতর আস্থার সংকট রয়েছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন, যেটি ছিল বর্তমান কমিশনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট কেস, সেখানে তারা কতটুকু সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পেরেছে, তা নিয়েও অনেকের মনে সন্দেহ জন্মেছে। এই নির্বাচনে কমিশন সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬ প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। বিধিমালার ২২ ধারার অধীনে কমিশন ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ হিসেবে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে এলাকা ছাড়ার একটি নির্দেশ দেয়, যাতে তিনি কর্ণপাতও করেননি। বিধিমালার ৩১ ও ৩২ ধারায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের শাস্তি জেল-জরিমানা ও প্রার্থিতা বাতিলের বিধান থাকলেও নির্বাচন কমিশন তা প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে। শুধু তা-ই নয়, মাননীয় সিইসি দাবি করেন, একজন সংসদ সদস্য এভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও তাঁদের কিছুই করার নেই। এমনকি একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘সম্মানিত ব্যক্তির সম্মানহানি করা কমিশনের কাজ নয়।’ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল দাবি করেন, কমিশন সংসদ সদস্যকে এলাকা ত্যাগ করতে বলেনি, সংসদ সদস্যও কমিশনের নির্দেশ অমান্য করেননি এবং কমিশনও ব্যর্থ হয়নি। এসব অসংলগ্ন বক্তব্যের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে জনসমক্ষে শুধু হেয়প্রতিপন্নই করা হয়নি, বিধিবিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে অপারগতার কারণে কমিশনের সদস্যরা ‘আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত আমার পদের কর্তব্য পালনে’ও ব্যর্থতা প্রদর্শন করেছেন।
ছোট একটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ক্ষেত্রে একজন সংসদ সদস্যের বেলায় নির্বাচন কমিশন তাদের নির্বাচনী বিধিবিধান প্রয়োগে অপারগতা প্রদর্শন করলে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। কারণ, জাতীয় নির্বাচনে থাকবেন ৩০০ এমপি। পাশাপাশি থাকবেন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসংখ্য কর্মকর্তা, যাঁরা অতীতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া এতে থাকবেন সব কটি রাজনৈতিক দলের কয়েক হাজার প্রার্থী ও অসংখ্য নেতা-কর্মী। কুমিল্লায় মাত্র একজন সংসদ সদস্যের কাছে আত্মসমর্পণের প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান কমিশন এতগুলো শক্তিশালী পক্ষকে কীভাবে সামলাবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কার কারণ রয়েছে।
আগামী নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কার আরেকটি কারণ হলো ইভিএম। ইভিএম ব্যবহারে ভোটের বুথে ‘ডাকাত’-এর কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু ইভিএমের ক্ষেত্রে আরও অনেক ডাকাত নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। যেমন কেন্দ্রের প্রিসাইডিং বা পোলিং কর্মকর্তারা তাঁদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা ব্যবহার করে ফলাফল বদলে দিতে পারেন। যাঁরা ইভিএমের প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে জড়িত, তাঁরাও কারসাজি করতে পারেন। কুমিল্লার নির্বাচনে অন্তত একটি কেন্দ্রে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে, একজন ম্যাজিস্ট্রেট যা তদন্ত করতে বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন। সর্বোপরি ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে কমিশনও নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবিত করতে পারে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের ইভিএমের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ ওভাররাইড করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। এসব কারণে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে ডিজিটাল জালিয়াতি হওয়া সম্ভব।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শেষ চারটি কেন্দ্র, যেখান থেকে ফলাফল সবার পরে এসেছে, সেখানে ইভিএম ডাকাতের কবলে পড়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইভিএম থেকে ফলাফল পাওয়ার কথা থাকলেও চারটি কেন্দ্র থেকে তা পেতে চার ঘণ্টা দেরি হলো কেন? আর এই চারটি কেন্দ্রের ফলাফল থেকেই সরকারি দলের প্রার্থী অনেকটা অলৌকিকভাবে ৩৪৩ ভোটে জিতে যান, যদিও আগের ১০১টি কেন্দ্রের ঘোষিত ফলাফলে তিনি ৬২৯ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন। এ নিয়ে পরাজিত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু তাঁকে জোর করে হারিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। এই নাটকীয়তা নিয়ে আরও প্রশ্ন জাগে, যখন কমিশনের পক্ষ থেকে শেষ চার কেন্দ্রের ফল প্রকাশে বিলম্ব নিয়ে নানাভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কুমিল্লার ফলাফল নাটকীয়ভাবে বদলে যাওয়া নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা সুরাহার একমাত্র পথ হলো একটি নিরপেক্ষ তদন্ত। কিন্তু কমিশন সেই পথে হাঁটেনি।
আবার ইভিএমে ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) নেই, যে দুর্বলতার কারণে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি কমিটির প্রধান হিসেবে প্রয়াত ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী এই ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি। আর এই দুর্বলতার কারণে মনিরুল হকের অভিযোগের সত্য-মিথ্যা, কোনোটাই প্রমাণ করা যাবে না। কারণ, ভিভিপিএটিবিহীন ইভিএমে ভোট পুনর্গণনা বা অডিটের কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে কমিশনের প্রদত্ত ফলাফলই চূড়ান্ত।
এসব দুর্বলতা ছাড়াও নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে। যেমন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে যে ২৯৪টি আসনে ব্যালট পেপার ব্যবহৃত হয়েছিল, তাতে ভোট পড়ার হার ছিল ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশ, তার বিপরীতে ইভিএম ব্যবহৃত ছয়টি আসনে ভোট পড়ার হার ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ কম। এমনকি কুমিল্লা সিটি নির্বাচনেও ২০১৭ সালের তুলনায় এবার ভোট পড়ার হার প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে। কিন্তু এই ইভিএম ব্যবহার করার জন্যই যেন নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছে।
ইভিএমের এসব দুর্বলতা এবং কমিশনের নিজের গঠন নিয়ে বিরোধী দলসমূহের আস্থার ঘাটতি এবং আইনকানুন প্রয়োগে সক্ষমতার অভাবের কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা নিয়ে এরই মধ্যে অনেক নাগরিকের মনে গুরুতর প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। নির্বাচনের সময় যদি সরকার তথা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ আচরণ না করে, রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত সরকারি দল যদি সদাচরণ না করে এবং গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ যদি যথার্থ নজরদারি না করতে পারে, তাহলে গ্রহণযোগ্য আগামী নির্বাচনের আশা দুরাশাই থেকে যাবে। এই দুরাশার অবসান না হলে এবং ২০২৩ সালের শেষে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে জাতি হিসেবে আমরা এক ভয়াবহ দুর্যোগের দিকে ধাবিত হতে পারি।
Leave a Reply