জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ সংশোধন করে গত ৬ এপ্রিল সরকার তাতে প্রশাসক নিয়োগের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে। এই বিধান অনুযায়ী নির্বাচিত জেলা পরিষদ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে সরকারকে সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের জন্য অনির্বাচিত প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রশাসক নিয়োগ না করা পর্যন্ত পরিষদের প্রধান নির্বাহীকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দিয়ে ১৭ এপ্রিল একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার ৬১টি জেলা পরিষদ বিলুপ্ত করে। এভাবে জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ নানা প্রশ্নের উদ্রেক করছে। এর মাধ্যমে সরকার পছন্দের ব্যক্তিদের জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে, যদিও বিলুপ্ত পরিষদের বিদায়ী চেয়ারম্যানরাও সরকারদলীয়। তবে সব জেলা পরিষদে এভাবে প্রশাসক নিয়োগ সংবিধানের ওপর একটি নগ্ন হামলা বলে আমরা মনে করি।
জেলা পরিষদের প্রতিনিধিদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও সরকার কেন তা করেনি? এ ক্ষেত্রে এবং নির্বাচিত জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়ার জন্য সরকার করোনাভাইরাসের দোহাই দিচ্ছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আমরা দেখেছি, করোনা মহামারির সময় অন্যান্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনও হয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অন্যান্য নির্বাচনের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচনও করতে পারত।
এ ব্যাপারে সরকারের আরেকটি যুক্তি হলো, যেহেতু কিছু ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন যথাসময়ে হয়নি, তাই জেলা পরিষদের নির্বাচনও যথাসময়ে করা সম্ভব হয়নি। কারণ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জেলা পরিষদের নির্বাচকমণ্ডলীর অংশ। এ যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ইউনিয়ন পরিষদের বিরাজমান সদস্যদের নিয়েই সরকার নির্বাচন করতে পারত।
প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে অনির্বাচিতদের দিয়ে জেলা পরিষদ পরিচালনার ভয়াবহ দিক হলো, সরকারের এ সিদ্ধান্ত আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের চারটি মূলনীতির একটি। গণতন্ত্র মানে প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন; তা কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত। কেন্দ্রে যেমন নির্বাচিত সরকার রয়েছে, তেমনিভাবে গণতন্ত্রের স্বার্থে জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত জেলা পরিষদ, উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচিত ইউনিয়ন থাকা সাংবিধানিকভাবে বাধ্যতামূলক। তাই জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ হলে সেখানে আর গণতন্ত্র থাকে না, যা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়।
প্রসঙ্গত, যে যুক্তিতে তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক; একই যুক্তিতে স্থানীয় সরকারে ১৮০ দিনের জন্য অনির্বাচিত প্রশাসকও অসাংবিধানিক। অনেকেরই মনে আছে, ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধানীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল- নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া এক দিনও সরকার থাকা অগণতান্ত্রিক এবং তা সংবিধানের লঙ্ঘন। সে জন্য নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদিও ৯০ দিনের জন্য একটি সাময়িক ব্যবস্থা ছিল, তবুও গণতন্ত্রের তথা নির্বাচিত সরকারের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার যুক্তিতে তা বাতিল করা হয়। তাহলে জেলা পরিষদে কেন অনির্বাচিতদের বসানো হবে?
অনির্বাচিতদের মাধ্যমে জেলা পরিষদ পরিচালনা সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদেরও স্পষ্ট লঙ্ঘন। ৫৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ এখানে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে, যেখানে আইন অনুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এগুলো পরিচালনা করবেন। সংবিধান যেখানে নির্বাচিতদের কথা বারবার বলছে, সেখানে কোন যুক্তিতে অনির্বাচিতদের বসানো হচ্ছে?
জেলা পরিষদ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে তৃণমূলের জনসাধারণের যথাযথ উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। যখন এ প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী ও জনবান্ধব করা প্রয়োজন, তখন জেলা পরিষদে অনির্বাচিত প্রশাসক বসানোর পদক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। জেলা পরিষদ গঠন না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসক নিয়োগের চিন্তা না করে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করাই সমস্যার মূল সমাধান। তাই জেলা পরিষদগুলোতে অতিসত্বর নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
পরিশেষে, বিদ্যমান জেলা পরিষদ আইনটি ধারণাগতভাবে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ এবং মূলত মান্ধাতার আমলের চিন্তা-চেতনারই প্রতিফলন। এটি অনেকটা আইয়ুব খানের আমলের মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে গড়া। আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত তার জেলায় জেলায় সরকার (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০২) গ্রন্থে আইনটির কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন : ‘২০০০ সালের জুলাই মাসে যে জেলা পরিষদ আইন পাস হয়েছে তাতে একটি অথর্ব জেলা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রায় দেড়শ জন নির্বাচক নিয়ে হয়েছে জেলার নির্বাচকমণ্ডলী এবং তারা ২১ জন প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। জেলার প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সদস্য, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের সব চেয়ারম্যান/মেয়র ও কমিশনারবৃন্দ এবং উপজেলার চেয়ারম্যানরা ভোট দিয়ে নির্বাচন করবেন জেলা চেয়ারম্যান, পাঁচজন মহিলা সদস্য ও ১৫ জন অন্যান্য সদস্য। পরোক্ষ নির্বাচনের চূড়ান্ত আর কাকে বলে। এই যে জেলা পরিষদ হবে তার না থাকবে কোনো সম্পদ, না থাকবে কোনো দায়িত্ব ও ক্ষমতা অথবা কোনো জনবল। এই আইনটি এতই অর্থহীন যে, এটি কোনোদিন কার্যকর হবে বলে ধারণা করা যায় না’ (পৃ. ৫১)। তার মতে, জেলা পরিষদ ‘আইনটি রহিত করে নতুন করে আইন প্রণয়ন হবে নতুন জাতীয় সংসদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য’ (পৃ. ২৫৯)। তাই আইনটির পুনর্বিন্যাস আজ জরুরি। আমরা আশা করি, সরকার ভবিষ্যতে আইনটিকে যুগোপযোগী করে একটি আধুনিক জেলা পরিষদ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেবে।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন
তথ্য সূত্র: সমকাল | ২২ এপ্রিল ২০২২
Leave a Reply