আমরা বহুদিন থেকেই নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া বিতর্কমুক্ত রাখা এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের দাবি করে আসছিলাম। অবশেষে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ২৭ জানুয়ারি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে বটে, কিন্তু সেটি প্রত্যাশিত হয়নি। আইনটি পাস করা হয়েছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা না করেই। উপরন্তু আমরা দেখছি, এটি অতীতের অনুসন্ধান কমিটির বিধানকেই আইনে পরিণত করেছে। এই আইন নিয়ে বিস্তর সমালোচনা থাকলেও তার ভিত্তিতেই সরকার সম্প্রতি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে।

তার পরও আমরা চাই এ অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক এবং এ কমিটি যোগ্য, দক্ষ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পথ প্রশস্ত করুক। অতীতের অনুসন্ধান কমিটির মতো তারা যদি একই অস্বচ্ছ পদ্ধতি অনুসরণ করে, তাহলে যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের পথ রুদ্ধ হবে। ফলে পরবর্তী সব নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা থেকে যাবে।
আমরা জানি, বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির এক সদস্য গত সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, কমিটির প্রধানও এর আগে সার্চ কমিটির সদস্য ছিলেন। ওই কমিটির সুপারিশেই বিতর্কিত নূরুল হুদা কমিশন গঠিত হয়েছিল। তাই, এ কমিটি কতটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার কারণ রয়েছে। তবে অনুসন্ধানের নামে অতীতের মতো অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে আবারও সরকারের অনুগত ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিলে তা জাতির জন্য মহাবিপদ ডেকে আনবে।
আমরা মনে করি, অনুসন্ধান কমিটি চাইলে বিদ্যমান আইনেও যোগ্য নির্বাচন কমিশন উপহার দিতে পারে। ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’-এর ৪(১) ধারায় নির্ধারিত অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলি হলো- ‘অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করিয়া দায়িত্ব পালন করিবে এবং এই আইনে বর্ণিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করিয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করিবে।’

এই দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য কমিটিকে আইনের ৩(২) ধারায় তার সভার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই দুটি বিধানকে কাজে লাগালে অনুসন্ধান কমিটির পক্ষে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সত্যিকারের অনুসন্ধানের মাধ্যমে যোগ্য, অভিজ্ঞ, সৎ ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। তবে অনুসন্ধানের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন হবে কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য সম্ভাব্য ব্যক্তিদের নাম আহ্বান। আইনের ৩(৩) ধারায় বলা আছে- অনুসন্ধান কমিটি ‘রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নিকট হইতে নাম আহ্বান করিতে পারিবে।’ এ ধারা থেকে স্পষ্ট- কমিটি অন্যদের কাছ থেকেও নাম আহ্বান করতে পারবে। আমরা শুনেছি, অনুসন্ধান কমিটি ইতোমধ্যে চিঠি দিয়ে রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে নাম আহ্বান করেছে। আমরা নিশ্চিত নই, কমিটি জনগণের কাছ থেকেও নাম আহ্বান করেছে কিনা। যদি না করে থাকে, তাহলে আইনের ৩(৩) ধারা লঙ্ঘিত হবে বলে আমরা মনে করি। তাই কমিটিকে অন্যদের কাছ থেকে নাম আহ্বানের আমরা অনুরোধ জানাই।


আইনের ৫ ধারায় নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য বাংলাদেশের নাগরিকত্ব, ৫০ বছর বয়স ও ২০ বছরের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আইনের ৬ ধারায় দেউলিয়া, অপ্রকৃতিস্থ, বৈদেশিক নাগরিকত্ব, যুদ্ধাপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত এবং প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগপ্রাপ্তকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এসব যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি পূরণ করে এমন হাজার হাজার ব্যক্তি বাংলাদেশে রয়েছেন। তাই কমিটির পক্ষে তাদের মধ্যে যে কোনো ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা ১০ জনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব।
কিন্তু শুধু আইনের ৫ ও ৬ ধারার যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ড পূরণ করলেই কোনো ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের উপযুক্ত হয়ে যান না। কারণ কমিশনকে সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্ধারিত সংসদ নির্বাচনসহ আরও অনেক সংবেদনশীল দায়িত্ব পালন করতে হয়। এসব দায়িত্ব পালনে আরও বড় বা ‘সুপিরিয়র’ যোগ্যতা আবশ্যক, যা আইনের ৪(১) ধারায় বলা আছে।

আমরা এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ অনুসন্ধানের ওপর জোর দিতে চাই। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ আনুষঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে ব্যক্তির সততা ও সুনামের বিকল্প নেই। ব্যক্তির সুনাম-দুর্নাম- ব্যক্তি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা বা প্রচলিত বিশ্বাস, যা যাচাই করার সঠিক ও উপযুক্ত মাধ্যম হলো তাদের সম্পর্কে জনশ্রুতি। বস্তুত জনগণের মতামতই এর একমাত্র গ্রহণযোগ্য নির্ণায়ক। তাই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য বিবেচিত ব্যক্তিদের নাম যদি প্রকাশ করা হয়, তাহলেই তাদের সুনাম-দুর্নাম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে, যা চালুনির ভূমিকা পালন করে সঠিক ব্যক্তিদের বেছে নিতে সহায়তা করবে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের দূরে রাখবে। যেমন, বিবেচিত ব্যক্তিদের নামগুলো প্রকাশিত হলে তাদের জীবনযাত্রা প্রণালি জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা; তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আছে কিনা কিংবা তাদের কোনোরূপ দলীয় সংশ্নিষ্টতা আছে কিনা ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য বেরিয়ে আসবে।

আমি মনে করি, অনুসন্ধান কমিটির বিবেচনাধীন নামগুলো দু’বার প্রকাশ করা আবশ্যক। প্রথমবার বিভিন্ন সূত্র থেকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত নামগুলো প্রাপ্তির পর এগুলো বাছাই করে একটি প্রাথমিক তালিকা করা যায়। তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের সম্মতি সাপেক্ষে কমিটি গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করতে পারে। এর পর সাক্ষাৎকার গ্রহণ, শুনানিসহ বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান পরিচালনার পর অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের জন্য যে ১০ জনের নামের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করবে, তা একটি প্রতিবেদনসহ প্রকাশ করতে পারে। কোন যোগ্যতার কারণে এবং কোন যুক্তিতে তারা চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেলেন, তা এ প্রতিবেদনে থাকবে এবং চূড়ান্ত তালিকা ও প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের অন্তত তিন দিন আগে কমিটি এগুলো গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করবে, যাতে জনগণ তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সময় পান। আর এভাবেই স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেওয়া সম্ভব।

বস্তুত দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা রক্ষায় স্বচ্ছ অনুসন্ধানের কোনো বিকল্প নেই। গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে যেভাবে সহিংসতায় মানুষের রক্ত ঝরছে; ভোট যেভাবে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাতে নির্বাচন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যেখানে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত; ভোটাধিকার প্রয়োগ যেখানে মানুষের অধিকার, সেখানে নির্বাচন নিয়ে যা হচ্ছে, তা চলতে দেওয়া যায় না। আমরা প্রত্যাশা করি, অনুসন্ধান কমিটি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে একটি প্রত্যাশিত নির্বাচন কমিশন উপহার দিয়ে এ সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল সহযোগিতার মনোভাব দেখিয়ে সমাধানের পথ সহজ করবে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন

তথ্য সূত্র: সমকাল | ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২