আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল রবিবার জাতীয় সংসদে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ উত্থাপন করেছেন। ২০১২ ও ২০১৭ সালে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে রাষ্ট্রপতি ইসি নিয়োগ করেছিলেন, সে প্রক্রিয়াই আইনের অধীনে আনা হচ্ছে এই বিলের মাধ্যমে। সাত দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বিলটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে যে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।

২.

বহুল প্রতীক্ষিত ইসি নিয়োগের আইন প্রণয়নের উদ্যোগ অবশ্যই আশাব্যঞ্জক, কিন্তু সব অংশীজনের মতামত গ্রহণ ছাড়া এ রকম জনগুরুত্বপূর্ণ একটি আইন পাসের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মাননীয় মন্ত্রী নিজেও বলেছেন, ‘এই আইনটা এমন একটি আইন হওয়া উচিত, যেটা গ্রহণযোগ্য হবে সবার কাছে। শুধু এক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে তো এটা সর্বজনীন আইন হলো না। ’ তাই হঠাৎ করে এভাবে আইনের অনুমোদনকে মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে ৫০ বছরে প্রথম আইনের ঘাটতি পূরণ করার বিষয়টিকে রাজনৈতিক প্রচারের স্বার্থে ব্যবহার করা হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

অনুমোদিত খসড়া বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, খসড়া আইনটির সঙ্গে অনুসন্ধান কমিটির জন্য ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির জারি করা প্রজ্ঞাপনের পার্থক্য নেই বললেই চলে। কত সদস্যের কমিটি গঠিত হবে, কমিটির সদস্য কারা হবেন, কমিটির ওপর অর্পিত দায়িত্ব, কমিটির কার্যদিবস, কমিটির কোরাম গঠন, প্রতি পদের বিপরীতে সুপারিশকৃত নামের সংখ্যা, সাচিবিক সহায়তা—এই বিষয়গুলো প্রস্তাবিত খসড়া ও ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপনে অভিন্ন। কমিটির কার্যাবলির ক্ষেত্রে নাম আহ্বানের বিষয়টি যোগ হয়েছে এবং অন্যদিকে ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপনে নাম সুপারিশের ক্ষেত্রে ন্যূনতম একজন নারী রাখার বিষয়টি থাকলেও খসড়া থেকে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপন ও মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়ার তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে এটি পরিষ্কার যে এটা ঠিক নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন নয়, ‘অনুসন্ধান কমিটি’ গঠনের আইন। অনুসন্ধান কমিটি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির জারি করা নির্দেশনাকে আইনি মোড়ক দেওয়াই যেন এর উদ্দেশ্য। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে গঠিত দুটি কমিশনের অভিজ্ঞতা দেশবাসীর জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। তাই নতুন মোড়কে পুরনো রীতির প্রচলন কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। পুরনো পথে হেঁটে নতুন গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

৩.

নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল প্রক্রিয়া তদারকির দায়িত্ব সংবিধান এই প্রতিষ্ঠানটির ওপর ন্যস্ত করেছে। তাই কমিশনে সৎ, যোগ্য ও সাহসী ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার আইনি কাঠামো তৈরিই নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, যাতে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যেকোনো পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অটল থাকেন। আর এই উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে অনুসন্ধান কমিটির কার্যাবলি চুলচেরা বিশ্লেষণ ও নজরদারির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। সত্যিকারের অনুসন্ধান চালিয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সাহসী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আনতে হবে, যাতে তাঁরা আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নৈতিকতা ও সাহসিকতার সঙ্গে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই সরকারের খসড়া প্রস্তাব থেকে বাদ পড়ে গেছে। সরকার প্রস্তাবিত খসড়া অনুসন্ধান কমিটির কার্যাবলির স্বচ্ছতা নিশ্চিতের ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ; বরাবরের মতো কমিটি কাদের নাম সুপারিশ করছে, কিভাবে সেসব নাম বাছাই করা হয়েছে—তা জনসমক্ষে প্রকাশে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। ফলে নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনগণ অন্ধকারেই রয়ে যাবে, যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য কাম্য নয়।

প্রস্তাবিত খসড়ায় কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার যে মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে তা সবই দালিলিক প্রমাণের বিষয়। কেউ বাংলাদেশের নাগরিক কি না, বয়স ৫০ বছর হয়েছে কি না, ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা আছে কি না, কিংবা খসড়ায় উল্লিখিত অযোগ্যতার আওতায় পড়েন কি না—তা কিছু দালিলিক কাগজপত্র পরীক্ষা করলেই যাচাই করা সম্ভব। কিন্তু একজন ব্যক্তি খসড়ায় উল্লিখিত যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠিতে উতরে যাওয়ার পরও কমিশনার হওয়ার জন্য তিনি কী কী বিশেষ যোগ্যতা বা গুণের অধিকারী—এটাই মূল বিচার্য বিষয়। এখানেই যত তর্ক-বিতর্ক। এ তর্ক-বিতর্ককে যথাযম্ভব কমিয়ে এনে সবার জন্য কল্যাণকর একটি সর্বজনীন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যই কমিটির কার্যাবলিকে স্বচ্ছ রাখাসহ যাচাই প্রক্রিয়ায় নাগরিক ও রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। অনুসন্ধান কমিটি সুপারিশ প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার চর্চা না করলে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশেই নিয়োগ সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

৪.

নাগরিক সংগঠন সুজন দেশের চিন্তাশীল ও বিশেষজ্ঞ নাগরিকদের মতামত নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন শিরোনামে একটি খসড়া আইন প্রস্তুত করে। ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর আইনের খসড়ার একটি কপি আইনমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তরও করা হয়। জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনা করে আইন প্রণয়নে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুজনের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হয়। তবে গত ১৭ জানুয়ারি অনেকটা আকস্মিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়।

সুজন প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় কমিটির কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিতের বিষয়টিই মূল বিষয়। সুজন প্রস্তাবিত খসড়ায় অনুসন্ধান কমিটির সদস্য সাতজন রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। যাচাই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা রাখার জন্য কমিটিতে তিনজন সংসদ সদস্য রাখার প্রস্তাব করেছে সুজন। এ ছাড়া থাকবেন নাগরিক সমাজের একজন এবং গণমাধ্যমের একজন প্রতিনিধি, যাঁরা আবার মনোনীত হবেন বাকি পাঁচ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে। অন্যদিকে সরকারের খসড়ায় থাকা দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত হবেন।

সরকারের খসড়ার সঙ্গে সুজন প্রস্তাবিত খসড়ার বড় পার্থক্য হলো, সুজন প্রস্তাবিত খসড়ায় কমিটির কার্যাবলির স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য নামের তালিকা প্রকাশ এবং যাচাই প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের জন্য গণশুনানির বিধান রাখা হয়েছে। কমিটির নাম যাচাই প্রক্রিয়াকে আরো পুঙ্খানুপুঙ্খ করার লক্ষ্যে দুই ধাপে নামের তালিকা প্রকাশের বিধান রাখা হয়েছে—১৫ থেকে ২০ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা এবং সাতজনের চূড়ান্ত তালিকা। শুধু তা-ই নয়, সুজন প্রস্তাবিত খসড়ায় যাচাই প্রক্রিয়া সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশের বাধ্যবাধকতাও রাখা হয়েছে। রাখা হয়েছে কমিটির সভার পূর্ণাঙ্গ কার্যবিবরণী এবং সদস্যদের ভোট প্রদানের তথ্য লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণের বিধান। কোনো নাগরিক যদি কমিটির সভার কার্যবিবরণীর অনুলিপি পাওয়ার জন্য আবেদন করেন, তবে অনতিবিলম্বে প্রদান করার বিধান রাখা হয়েছে, যাতে নাগরিকদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত হয়। এ ছাড়া নারী কমিশনার নিশ্চিত করার জন্য প্রাথমিক তালিকায় ন্যূনতম পাঁচজন এবং চূড়ান্ত তালিকায় ন্যূনতম দুজন নারী রাখার প্রস্তাব করেছে সুজন; দুঃখজনকভাবে সরকারের প্রস্তাবনায় কমিশনে নারী কমিশনার রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি।

বলাবাহুল্য, সুজন প্রস্তাবিত কার্যাবলি সম্পাদন সময়সাপেক্ষ; এ জন্য খসড়ায় কমিটির কার্য সম্পাদনের জন্য এক-দুই মাস সময় রাখা হয়েছে। কিন্তু সরকারের খসড়ায় সময় রাখা হয়েছে মাত্র ১০ কার্যদিবস, এত স্বল্প সময়ে কমিটি কিভাবে অনুসন্ধান ও যাচাই প্রক্রিয়া সম্পাদন করবে তা আমাদের বোধগম্য নয়। সরকার প্রস্তাবিত খসড়ায় অনুসন্ধান কার্যক্রম রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

৫.

সুজন প্রস্তাবিত খসড়ায় যেখানে কমিশনের কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে প্রণয়নকৃত আইনের অধীনে গঠিত কমিশনের জ্যেষ্ঠতম কমিশনারকে পরবর্তী প্রধান কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সরকারের খসড়ায় এর আগে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির কার্যাবলি ও সুপারিশে গঠিত কমিশনকে বৈধ বলে গণ্য করার এবং উক্ত বিষয়ে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না বলে বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। আগের দুটি কমিশন কর্তৃক মানুষের ভোটাধিকার হরণ ও নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করার দায় থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই এ বিধান রাখা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দায় না নেওয়া ও দায় থেকে মুক্তি লাভের যে দৃষ্টান্ত রয়েছে এটি তারই ধারাবাহিকতা। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ও সুশাসনের ভিত্তির ওপর শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হলে কৃতকাজের জন্য জবাবদিহি ও শাস্তি ভোগ না করে দায়মুক্ত করে দেওয়ার এই ধারা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব বিতর্কমুক্ত রাখা এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্যই নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে কমিশনার নিয়োগের আইন প্রণয়নের দাবি করে আসছে। লক্ষ্য—সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। একটি আইন করে পুরনো প্রক্রিয়াকে নতুন মোড়ক দিলে সে উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। উল্টো আরো বিতর্ক হবে। তাই সব পক্ষের মতামত নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি যুগোপযোগী ও যথাযথ আইন প্রণয়ন করতে হবে।

লেখক : সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

 তথ্য সূত্র: কালের কন্ঠ | ২৪ জানুয়ারি, ২০২২