আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতা বেড়েই চলেছে। ১১ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় ৩৭১টি ইউপি নির্বাচনে পাঁচজন, ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৬টি ইউপি নির্বাচনে ২৪ জন নিহত হয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপের ২৪ জনের মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। এই ২৪ জনের মধ্যে কেবল নরসিংদীতে মারা গেছেন নয়জন (একটি জাতীয় দৈনিক, ১৪ নভেম্বর ২০২১)। নির্বাচনের প্রচার চলাকালেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত নয়বার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন চলছে দশমবারের নির্বাচন। আমাদের দেশে নির্বাচন সম্পর্কে জনমনে এমন একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, নির্বাচন একদিকে যেমন উৎসবের আবহ তৈরি করে, পাশাপাশি কখনো কখনো তা প্রার্থী, দল ও সমর্থকদের অসহিষ্ণুতার কারণে সহিংসতার উপলক্ষ হিসেবেও আবির্ভূত হয়। আর এই সহিংসতা অনেক মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলোর প্রাণহানির তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, ১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩ ও ১৯৯২-এ প্রাণহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি। ১৯৮৮ সালে ৮০ জন, ১৯৯৭ সালে ৩১ জন, ২০০৩ সালে ২৩ জন এবং ২০১১ সালে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা যায় (একটি জাতীয় দৈনিক, ৪ এপ্রিল ২০১৬)। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একটি জাতীয় দৈনিকের (৬ জুন ২০১৬) পরিসংখ্যান অনুযায়ী অন্তত ১০৯ জনের প্রাণহানি (সুজন সচিবালয়ের তথ্যানুযায়ী নিহত ১৪৩ জন) এবং পাঁচ সহস্রাধিক আহত হন। অর্থাৎ অতীতের নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল ২০১৬ সালে। আমাদের আশঙ্কা যে, সর্বশেষ দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে যে হারে সহিংসতা হয়েছে তা অব্যাহত থাকলে এবারের নির্বাচনে সহিংসতার পরিমাণ গতবারের চেয়ে বাড়তে পারে।

কিন্তু কেন এত সহিংসতা? প্রথমত, আমার মনে হয়, এর একটি প্রধান কারণ সুবিধাবাদের রাজনীতি। জনকল্যাণের জন্য কাজ করেন, দেশে এখন এমন রাজনীতিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এখন যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের প্রায় সবাই ব্যস্ত ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ রক্ষায়। অনেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন কিছু পাওয়ার জন্য। অথচ আমরা জানি, রাজনীতি একটি মহান পেশা; এই পেশায় নিয়োজিতদের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করা। গণতন্ত্র চর্চার শত শত বছরের অভিজ্ঞতা ও পøিতদের প্রজ্ঞা কাজে লাগানো সম্ভব না হলে সহিংসতার বৃত্ত থেকে বের হওয়া কঠিন।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা থাকেন তারা এবং তাদের অনুসারীরা যাতে কোনো রকম অন্যায় করে পার পেতে না পারে এবং সুবিধাবাদের রাজনৈতিক চর্চা করতে না পারে তার জন্য দেশে সাংবিধানিক, বিধিবদ্ধ ও রাষ্ট্রবহির্ভূত (সিভিল সোসাইটি ও রাজনৈতিক দল) প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে সুবিধাবাদের রাজনীতির অবসান ঘটাতে না পারলে উল্লেখিত রোগ দূরীভূত হবে না, রোগ নিরাময় হবে না এবং সহিংসতা দূর হবে না।

অনেকেই মনে করেন, ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ পেলে সহজে নির্বাচিত হওয়া যাবে। এজন্য তারা মনোনয়ন পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং তখনো সহিংসতার সৃষ্টি হয়।

আরেকটি বিষয় হলো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। দলের ভেতরেও গণতন্ত্র-স্বচ্ছতা নেই। এমন একটা পরিস্থিতিতে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তটিই ঠিক ছিল না। এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের একেবারে শেষ স্তরে একটা বিষবৃক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। এ অবস্থায় মনোনয়ন বাণিজ্য হচ্ছে। পাশাপাশি মারামারি ও হানাহানিতে রক্ত ঝরছে, প্রাণহানি হচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোটের সময় প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করার মরিয়া চেষ্টা দেখা যায়। এ লক্ষ্যে অতীতে আমরা দেখেছি যে, নির্বাচনে সহিংসতা হতো আন্তঃদলীয় তথা প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থকদের মধ্যে। কিন্তু এবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহিংসতা হচ্ছে অন্তর্দলীয়। এর কারণ হলো এবারের ইউপি নির্বাচনে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নেই। ফলে তাদের মাঠছাড়া করার আর সেভাবে দরকার পড়ছে না। তাই আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরোধ হচ্ছে। উভয়েরই যেহেতু খুঁটির জোর আছে, তাই কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। এর ফল প্রভাব বিস্তার, জবরদখল এবং রক্তপাত।

তবে যে কোনো নির্বাচনী অনিয়ম ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রতিকারে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যদি কঠোর হতো তা হলে সহিংসতা কমত। কিন্তু ইসিকে তেমন ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। যেমন, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে প্রচার চলাকালে ব্যাপকভাবে অস্ত্রের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তবু ভোটের আগে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের ধরতে বিশেষ কোনো অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। যার ফলস্বরূপ ঘটে যায় ২৪ জনের প্রাণহানি। অন্যদিকে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় বিব্রত ভাব প্রকাশ করেই যেন দায়িত্ব শেষ করছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। ‘ঘরে ঘরে পাহারা দিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা থামানো যায় না’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি (একটি জাতীয় দৈনিক ১৪ নভেম্বর ২০২১)। এমনকি ‘নির্বাচনী সহিংসতার দায় ইসির নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার (একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ১১ নভেম্বর ২০২১)।

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে তারা এবারের নির্বাচনকে নির্বাসনে নিয়ে গেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল অনুষঙ্গ রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ইসি। রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী প্রতিপক্ষকে হটিয়ে দিতে চাইবে- এটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বাভাবিক। বাকি তিনটি পক্ষ নিরপেক্ষ ও শক্ত ভূমিকা পালন করলে সমস্যা হতো না।

প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহায়তা না করলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে একা সুষ্ঠু ভোট করা সম্ভব নয়। তবে নির্বাচন কমিশন একা চাইলে খারাপ নির্বাচন এড়াতে পারে। যেমন আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে ইসি। যে প্রার্থীর পক্ষে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে, তার প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে। নির্বাচনের দিন ভোট বাতিল করতে পারে ইসি। এমনকি চাইলে ভোটের পর ফলাফলও বাতিল করার এখতিয়ার তাদের আছে। আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম মামলার (ডিএলআর ৪৫, ১৯৯৩) রায়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করা করণীয়, তার সবই করতে পারবে, এমনকি আইন ও বিধি-বিধানের সংযোজনও করতে পারবে।

ভোটের মাঠে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইসির অধীনে। এ দুই জায়গায় থেকে পক্ষপাত হলে ইসি কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু তারা এর কোনোটাই করছে না। অর্থাৎ ইসি কাউকেই কোনো কড়া বার্তা দিতে পারেনি। প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল বুঝে গেছে, যত অন্যায়ই করুক না কেন, নির্বাচন কমিশন কিছু করতে পারবে না। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা মনে করছেন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের পক্ষে। ফলে কেউ কোনো আইন বা রীতির তোয়াক্কা করছে না। যে কোনো মূল্যে জয় পেতে চাইছে।

এক ইউনিয়নের মনোনয়ন পেতে এক ব্যক্তি কোটি টাকা খরচ করেছেন বলে শোনা গেছে। অথচ অনেক ইউনিয়নে কোটি টাকার কাজই হয় না। এটা থেকে বোঝা যায়, রাজনীতিক, ব্যবসায়ীদের হাতে প্রচুর অবৈধ টাকা এসেছে। এ টাকা বিনিয়োগ করে চেয়ারম্যান হতে পারলে তা অন্য ফায়দা নেওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। রাজনীতি বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এখন একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে সাংসদ হওয়ার অর্থ হচ্ছে সোনার হরিণ হাতে পাওয়া। পৌরসভা, উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা মেয়র পদও অনেক লোভনীয় হয়ে উঠেছে। এখানে জনস্বার্থ বা জনসেবার চেয়ে ফায়দা হাসিল করাই মুখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে। এ প্রতিযোগিতায় কেউ পিছিয়ে থাকতে চায় না। তাই যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে জয় পেতে সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছেন প্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকরা।

আজ আমাদের উপলব্ধিতে আনা দরকার যে, নির্বাচনে যদি সহিংসতা বন্ধ না হয় তা হলে দল-মত নির্বিশেষে আমাদের সবাইকেই এর পরিণতি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমি মনে করি, সহিংসতা ছাড়া পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলো সম্পন্ন করতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে আলাপ-আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও সুবিধাবাদের রাজনীতি দূর করা, নির্দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন করা, সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনকে তার দক্ষতা ও কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা দরকার। একই সঙ্গে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দেওয়া এবং ব্যাপক দলীয়করণের বলয় থেকে সরকারকে বের হয়ে আসতে হবে। এ ছাড়াও এই ঘৃণ্য সহিংসতা বন্ধে সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকেও জোর আওয়াজ তোলার দরকার বলে আমি মনে করি। তা হলেই দেশের সব নির্বাচন সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে এবং ভোটার তথা দেশবাসীর প্রত্যাশাও পূরণ হবে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক)

তথ্য সূত্র: আমাদের সময় | ১৮ নভেম্বর ২০২১