দুই ধাপে ১ হাজার ১৯৮টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এ নির্বাচনের পাঁচটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আমরা লক্ষ করছি। প্রথমত, দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বর্জন করেছে; যদিও দলটির কিছু নেতা–কর্মী এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তবে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচনে এ পর্যন্ত অনেক ইউনিয়নে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি বা নামকাওয়াস্তে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। ফলে তিন ধাপে ২৫৩ জন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনী বৈতরণি পার হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চাপ দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়েছে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনকে নির্বাচন বলা যায় না। কারণ, নির্বাচন মানেই বিকল্প থেকে বেছে নেওয়া। বিকল্পহীন পরিস্থিতিতে নির্বাচন নির্বাচন খেলা হয় এবং ভোটাররা তাঁদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হন।
তৃতীয়ত, এ নির্বাচনে ব্যাপক মনোনয়ন–বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। দলীয় মনোনয়ন হস্তগত করার জন্য প্রার্থীদের বিরাট অঙ্কের অর্থ ‘বিনিয়োগ’ করার কথা শোনা যাচ্ছে। তাই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই প্রার্থীদের ঢাকায় অবস্থান করে বিভিন্নভাবে মনোনয়ন প্রভাবিত করাতে দেখা গেছে। নানা প্রভাবের কারণে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী অনেক ক্ষেত্রে মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং জনগণের দোরগোড়ার এ প্রতিষ্ঠান চরমভাবে কলুষিত হয়ে পড়েছে।
একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে অনুধাবন করা দুরূহ হবে না যে আমাদের রাজনীতিতে অর্বাচীনভাবে আমরা যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছি, তারই ফসল ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে ভয়াবহ সহিংসতা, মনোনয়ন–বাণিজ্য ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া।
চতুর্থত, এসব নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ক্রমাগতভাবে বেশি হারে জয় লাভ করছেন। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ধাপে মাত্র ২৬ শতাংশ চেয়ারম্যান প্রার্থী নৌকা প্রতীক নিয়ে পরাজিত হলেও দ্বিতীয় ধাপে এ হার ৪২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ১৩১ ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই ছিল না। মনোনয়ন–বাণিজ্য ও নানা প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে মনোনয়ন বাগানো বেসামাল পর্যায়ে পৌঁছার কারণেই তা ঘটেছে। কারণ, আমরা অতীতে দেখেছি, দলভিত্তিক মনোনয়নের কারণে স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যাই শুধু কমে যায়নি, প্রার্থীর মানেও অবনতি ঘটেছে এবং সুযোগ পেয়ে ভোটাররা এসব অনাকাঙ্ক্ষিত প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ সরকারের অনেক অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তও এ ফলাফল সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে।
এ নির্বাচনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো হানাহানি ও প্রাণহানি। প্রথম দফায় পাঁচজনের প্রাণহানি হলেও দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনের দিন ও নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। লক্ষণীয় যে এবারের নির্বাচনে প্রায় সব দ্বন্দ্ব-হানাহানিই হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে। নির্বাচনী মাঠে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও কেন এমন হানাহানি?
আমাদের আশঙ্কা, চলমান ইউপি নির্বাচনে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং বিরাটসংখ্যক ব্যক্তির বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া রোগের লক্ষণমাত্র, রোগ নয়। এ ছাড়া এ দুটি সমস্যা একই সুতায় গাঁথা। এগুলোর টেকসই সমাধানের জন্য এর পেছনের রোগ চিহ্নিত করা আবশ্যক। টাইফয়েড বা ম্যালেরিয়া হলেও যেমন প্যারাসিটামল খেলে জ্বর সাময়িকভাবে ছেড়ে যায়, তেমনিভাবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়াকড়ি হয়তো এগুলোর, বিশেষত সহিংসতার সাময়িক সমাধান দিতে পারে, তবে এর টেকসই সমাধানের জন্য নেপথ্যের রোগের চিকিৎসা জরুরি।
একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে অনুধাবন করা দুরূহ হবে না যে আমাদের রাজনীতিতে অর্বাচীনভাবে আমরা যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছি, তারই ফসল ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে ভয়াবহ সহিংসতা, মনোনয়ন–বাণিজ্য ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া। রাজনীতি একটি মহান পেশা, যার উদ্দেশ্য জনকল্যাণ। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতির উদ্দেশ্য হয়ে গেছে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের কল্যাণ। অর্থাৎ রাজনীতিকে আমরা ব্যবসায় পরিণত করে ফেলেছি। জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থেই—কিছু পাওয়ার আশাতেই—এখন মানুষ আমাদের দেশে রাজনীতিতে যুক্ত হয়। দলের পদ-পদবি বা কোনো নির্বাচিত পদ পেলে প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ে এবং সেই প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। অর্থাৎ এসব পদ-পদবির মাধ্যমেই তাঁরা চলমান ফায়দাভিত্তিক রাজনীতির ফায়দার শিকলে যুক্ত হয়ে পড়েন। এ কারণে এসব পদ-পদবি ব্যবহার করে সহজে ও অযাচিতভাবে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া যায়। নানা রকমের অন্যায় ও অপরাধ করে পার পাওয়া যায়। এটা সম্ভব হয়, কারণ, আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দল আর সরকারের মধ্যে পার্থক্য বিলীন হয়ে গেছে এবং প্রায় সব অপকর্মই ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় ঘটে।দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বন্ধ করা না গেলে সহিংসতা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া বন্ধ করা যাবে না।
পদ-পদবি যত বড় হয়, ফায়দাপ্রাপ্তির সুযোগ তত বেড়ে যায়। সাংসদ হওয়া তো সোনার হরিণ পাওয়ার সমতুল্য। তাই এসব পদ-পদবি পেতে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা মরিয়া। যেহেতু ফায়দার পরিমাণ অঢেল নয়, তাই সংগত কারণেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা একে অপরকে মাঠছাড়া করতে উদ্যত হন। মনোনয়ন–বাণিজ্য, হুমকি-ধমকি ও অন্যান্য প্রভাব খাটিয়ে প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করতে না পারলে অপেক্ষাকৃত শক্তিমানেরা সহিংসতার আশ্রয় নেন। তাই সুবিধাবাদের রাজনীতির যে অপসংস্কৃতি আমরা সৃষ্টি করেছি, তা–ই মূলত সহিংসতার পেছনের প্রধান রোগ। উপরন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারলে মনোনয়ন–বাণিজ্যের মাধ্যমে করা বিনিয়োগের প্রতিদান সুনিশ্চিত হয়।
প্রসঙ্গত, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালিত এ ধরনের সুবিধাপ্রাপ্তির রাজনীতি বন্ধ করতেই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কতগুলো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে একটি নজরদারি কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। এ লক্ষ্যে কতগুলো সাংবিধানিক, বিধিবদ্ধ এবং রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির মতো রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান ‘গার্ডরেইল’ হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। রাজতন্ত্রের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে পণ্ডিতদের শত শত বছরের গবেষণালব্ধ শিক্ষা ও প্রজ্ঞারই প্রতিফলন এ নজরদারির কাঠামো, যার লক্ষ্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজনীতিবিদদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নেওয়া, তথা দুর্নীতি থেকে বিরত রাখা। যে রাষ্ট্রে এ কাঠামো ভেঙে পড়ে, অর্থাৎ জনসেবার পরিবর্তে ফায়দা পাওয়ার জন্য মানুষ রাজনীতিতে যুক্ত হয়, সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। কারণ, সেখানে ব্যক্তি-কোটারি ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ও আঁকড়ে ধরে থাকেন এবং সব নিয়ম-পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলেন। এসব শিক্ষাকে উপেক্ষা করে আমরা যে সুবিধাবাদের রাজনীতি, তথা ক্রোনিজম বা ফায়দাতন্ত্রে নিজেদের নিমজ্জিত করে ফেলেছি, এর আরও বড় মাশুল আমাদের ভবিষ্যতে গুনতে হবে। কারণ, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভবিষ্যতে আর কেউই ক্ষমতা ছাড়তে চাইবে না।
চলমান সহিংসতা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পেছনে আরেকটি রোগ হলো দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, যা দলবাজি ও সহিংসতা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেয়। ব্যাপক দলীয়করণের মাধ্যমে সৃষ্ট চরম পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নগ্ন পক্ষপাতিত্বের কারণে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচনে জেতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া জেতা প্রায় নিশ্চিত। তাই প্রার্থীরা একে অপরকে মাঠছাড়া করতে এবং নিজে মনোনয়ন বাগাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন, এমনকি সহিংসতারও আশ্রয় নেন। তাই দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বন্ধ করা না গেলে সহিংসতা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া বন্ধ করা যাবে না।
ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পেছনে আরেকটি রোগ হলো নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততা। বর্তমান নূরুল হুদা কমিশন ইতিমধ্যেই আমাদের নির্বাচনব্যবস্থাকে শুধু নির্বাসনেই পাঠায়নি, তারা নিজেরাও যেন নির্বাসনে চলে গেছে। তাই তো তারা সহিংসতায় লিপ্ত হওয়া এবং হুমকি-ধমকি প্রদানকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয় না কিংবা তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল করে না, যে ক্ষমতা কমিশনের আছে। পরিস্থিতি বেসামাল পর্যায়ে পৌঁছালেও নির্বাচন স্থগিত করে না বা বিতর্কিত ভোটের পর তদন্ত সাপেক্ষে নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করে না। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে অন্যায় করে পার পেয়ে গেলে অন্যায় উৎসাহিতই হয়। তাই অগাধ ক্ষমতাধর স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের নির্বিকার আচরণের প্রতিফলন নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনতা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
তথ্য সূত্র: প্রথম আলো | ১৭ নভেম্বর ২০২১
Leave a Reply