বদিউল আলম মজুমদার
জীবন হলো একটা অনন্য সুযোগ। নিজেকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ও নিজের বিকাশ ঘটানোর। সমাজের জন্য কিছু করার। অন্যের জীবনে অবদান রাখার, অন্যের জীবনকে স্পর্শ করার। যারা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় এবং অনুকূল পরিবেশে বড় হয়, তাদের জীবন সাধারণত স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়। তাদের জন্য এগিয়ে যাওয়া সহজ হয়। কিন্তু আমরা যারা পঞ্চাশের দশকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি, তাদেরও জীবন ছিল, কিন্তু বিকাশের সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। তারপরও নানান প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যেসব সৌভাগ্যবান মানুষ তাদের সম্ভাবনাকে কিছুটা হলেও কাজে লাগাতে পেরেছে, আমি তাদের একজন বলে মনে করি। বস্তুত আমি একজন অতি ভাগ্যবান ব্যক্তি, যদিও আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না।
আমার জন্ম ব্রিটিশ ভারতের বাংলায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে। ভয়াবহ পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে। এক অতিদরিদ্র পরিবারে।
আমার জন্ম হাসপাতালে নয়, বরং দাইয়ের সহায়তায় নিজেদের কুঁড়েঘরে। সেই সময় গর্ভাবস্থায় মায়েদের জন্য কোনো বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা ছিল না। বরং গর্ভবতী মাদের বলা হতো কম খেতে, যাতে বাচ্চা ছোট হয় এবং প্রসবের সময় মায়ের কম কষ্ট হয়। প্রসবসংক্রান্ত জটিলতা ও ইনফেকশনের কারণে তখন মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি।
আমার মা, আঞ্জুমেন্নেসা, বিয়ের পর অনেক বছর সন্তান ধারণ করতে পারেননি। ফলে সমাজের নানা কটূক্তি সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। অজ্ঞতাবশত অনেকেই এর জন্য তাঁকে দায়ী করে আমার বাবাকে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য প্ররোচিত করেন। এমনকি চাপও দেন। কিন্তু বাবা তাতে সায় দেননি। সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে অবশেষে আমি জন্মাই, যা আমাদের পরিবারের জন্য ছিল এক পরম আনন্দের। কারণ আমি ছিলাম বহু প্রতীক্ষিত এবং পরিবারের একমাত্র সন্তান।
আমি যখন শিশু, তখন ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয় এবং আমার জন্মস্থানের কাছেই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। আমার নানাবাড়ি নোয়াখালীতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। এটি ছিল একটি হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক ঘটনা। বহু নিরপরাধ মানুষকে তখন শুধু তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অহেতুক প্রাণ দিতে হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে সে সময় মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালীতে আসেন।
আমার বাবা স্কুলে ভর্তি হলেও দারিদ্র্যের কারণে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই তাঁকে বিখ্যাত জমিদার নবাব ফয়জুন্নেসার এস্টেটে নায়েব হিসেবে কাজ শুরু করতে হয়। কিন্তু ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে তিনি চাকরি হারান, যা আমার পরিবারকে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। একই সময়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে একটি মামলায় জড়িয়ে যাওয়ার কারণে পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। বাবা কিছুদিন পর সাময়িকভাবে সরকারি কাজে নিযুক্ত হলেও দুর্ভাগ্যক্রমে মাত্র ছয় বছর বয়সে আমি বাবার স্ট্রোকের শিকার হওয়া প্রত্যক্ষ করি। শারীরিক অক্ষমতা তাঁকে পুরোপুরি শয্যাশায়ী করে ফেলে।
আমার নিরক্ষর মাকেই তখন আমাদের পুরো পরিবারের হাল ধরতে হয়। সামান্য কিছু জমিজমা যা ছিল, তার অধিকাংশই বন্ধক দিয়ে বাবার চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে হয়েছে। অবশিষ্ট যেটুকু জমি ছিল, তাতে আমাকেই চাষাবাদ করতে হতো। আমার মা ছিলেন সবচেয়ে বড় ব্যবস্থাপক, কারণ তিনি এত সামান্য জমির আয় দিয়ে আমাদের পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। যদিও অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা জীবন ছিল অত্যন্ত কঠিন, তবে বাবা-মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসার পরিপূর্ণতায় আমি বড় হয়েছি।
আমার নিরক্ষর মা ছিলেন আমার শিক্ষক। তিনি কতগুলো মূল্যবোধ আমাকে শিখিয়েছেন, যা আমার ভবিষ্যৎ জীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন সর্বদা সত্য কথা বলতে। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কঠোর পরিশ্রম করতে। শৈশব থেকে শেখা এসব মূল্যবোধ আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছে এবং এগুলো আমি সারাজীবন চর্চা করেছি। এরই প্রতিফলন ঘটেছে শত ঝুঁকির মধ্যেও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমার সোচ্চার ভূমিকায়। আর কঠোর পরিশ্রম করা আমার জন্য স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
মা আমাকে নিজের মতো করে সম্রাট আলেকজান্ডারের গল্প বলতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘দুনিয়ারও বাদশা ছিল শাহ সেকান্দর, খালি হাতে চলে গেল কবরের ভিতর।’ তিনি আমাকে বোঝাতে চেয়েছেন পার্থিব সকল ধনসম্পদ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ আমরা আমাদের তিরোধানের সময় কী অবদান রেখে যাচ্ছি। আমাদের জীবনকে কতটুকু অর্থবহ করতে পেরেছি। তাই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা বাংলাদেশের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হলেও আমি সেদিকে হাঁটিনি। আমি আজীবন চেষ্টা করেছি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সরব হতে এবং আমার প্রতিবাদ ব্যক্ত করতে। মানবকল্যাণকেই আমি জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছি।
মা আমাকে আরও গল্প বলতেন বর্গীদের অত্যাচার সম্পর্কে। এসব গল্প থেকে বাল্যকালেই অত্যাচারীদের প্রতি আমার বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয় এবং আমি নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছি। স্কুলে পড়ার সময়ই আইয়ুব-মোনায়েমের নিপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছি। আমার এ প্রতিবাদী ভূমিকা আজও অব্যাহত রয়েছে।
আমার শৈশব কেটেছে সীমাহীন দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মাঝে। গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না, রাতের অন্ধকার কাটত কেরোসিন বাতির টিমটিমে আলোয়। আমরা সবাই একসঙ্গে একটি কাঠের চৌকিতে ঘুমাতাম। বর্ষাকালে আমাদের খড়ের চালার ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ত। কখনও কখনও ঝড়ে ঘরের চালা উড়ে যেত। খাবারের অভাব লেগেই থাকত। কার্তিক মাস ছিল চরম অভাবের সময়। সেই সময় দেশের অন্য এলাকা থেকে আলু ও কাঁঠাল ভরা নৌকা আসত এবং এসব দিয়ে আমরা জীবন ধারণ করতাম। অনাহার আমার মতো তখন অনেকেরই নিত্যসঙ্গী ছিল। এমন সংগ্রামের জীবন আমাকে শক্তিশালী করেছে এবং শিখিয়েছে যে দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতা জয় করেই এগিয়ে যেতে হবে।
আমাদের গ্রামে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা ছিল না। পানীয়জল পর্যন্ত নিতে হতো সেই পুকুর থেকে; যেখানে সবাই স্নান করত, গরু-ছাগলের গোসল দিত এবং কাপড় ধোয়া হতো। এতে প্রায়ই কলেরা ও ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ত। দুগ্ধপোষ্য শিশু হিসেবে আমি নিজেও কলেরায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। শুনেছি যে আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। বস্তুত, আমার বেঁচে থাকা ছিল এক অলৌকিক ঘটনা। তখন মানুষের জন্য শুধু দারিদ্র্য ও রোগ নয়, বিষাক্ত সাপের ভয়ও ছিল। ছোটবেলা একবার রাতের আঁধারে মা আমাকে বিছানা থেকে তুলে ঘরের বাইরে নিয়ে যান, কারণ তিনি ঘরে গোখরো সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনেছিলেন। সে রাতে আমাদের অন্য বাড়িতে গিয়ে ঘুমাতে হয়েছে। পরদিন প্রতিবেশীরা ঘরের মেঝে খুঁড়ে এক ডজনেরও বেশি গোখরো সাপের বাচ্চা ও মা সাপটিকেও মেরে ফেলে। ঘরের মাটির মেঝেতে ইদুরের গর্তে সাপ এসে বাসা বেঁধে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটানো ছিল তখন স্বাভাবিক ব্যাপার। এই ঘটনায় দীর্ঘদিন আমরা আতঙ্কে কাটিয়েছিলাম, যদি প্রতিশোধ নিতে সাপের সঙ্গী ফিরে আসে!
আমার শৈশব ছিল নানা চ্যালেঞ্জ ও বিপদের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এক জীবন। একদিন আমার মা প্রতিবেশীর ছাগল থেকে দুধ এনে ফুটিয়ে খেতে দিলেন। হঠাৎ খড়ের ছাদ থেকে একটি ছোট সাপ আমার বাটিতে পড়ল। মুহূর্তেই দুধ ছিটকে পড়ল, আর আমরা সবাই আতঙ্কে লাফিয়ে উঠলাম। সৌভাগ্যক্রমে সাপটি বিষাক্ত ছিল না। বর্ষাকালে এক সন্ধ্যায় স্কুল থেকে ফুটবল খেলে ফেরার পথে একটি সাপ আমাকে কামড়ায়। সহপাঠীরা তাড়াতাড়ি আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসে এবং ওঝাকে খবর দেওয়া হয়। মা ভয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সৌভাগ্যবশত এবারও সাপটি বিষধর ছিল না। তবে সেই সময়ে প্রতিবছর অনেকেই সাপের কামড়ে মারা যেত। এভাবেই একাধিকবার মৃত্যুর হাত থেকে আমি বেঁচে গিয়েছি। বস্তুত, আমি ছিলাম ‘মিরাকল চাইল্ড’, কারণ অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি বেঁচে ছিলাম!
আমাদের গ্রামের জীবন কঠিন ছিল, বিশেষ করে নারীদের জন্য। স্বামী, সংসার ও পরিবারের অন্যদের সেবা-যত্নের সব দায়িত্ব ছিল নারীদের ওপর। তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। গ্রামের অধিকাংশ নারী চরম অপুষ্টিতে ভুগত। তারা পরিবারের সবাইকে খাওয়ানোর পর নিজেরা খেত–কিছু থাকলে খেত, না থাকলে উপোস করত। অল্প বয়সেই তাদের বিয়ে দেওয়া হতো এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতা তাদের ছিল না। আমার মারও বিয়ে হয় ১৩ বছর বয়সে।
গ্রামে শিক্ষার হার ছিল অতি নগণ্য। ইংরেজি জানা মানুষ ছিলই না বলতে গেলে। তবে অল্প বিদ্যা যে কী ভয়ংকর হতে পারে তার একটি প্রমাণ আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম ছোটবেলায়। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তের পর আমার বাবা সরকারি চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে থাকতেন। চাকরির অংশ হিসেবে তাঁকে ডায়েরি রাখতে হতো। একবার তিনি ছুটির সময় বাড়িতে এসে ভুলে ডায়েরি ফেলে যান। কর্মক্ষেত্রে ফিরে তিনি একটি টেলিগ্রাম পাঠান–Send Diary Immediate (দ্রুত ডায়েরি পাঠাও)। সেই সময়ে আমাদের গ্রামে কেউই ইংরেজি জানত না। পাশের গ্রামের ইংরেজি জানা এক ব্যক্তিকে আনা হয় টেলিগ্রামটি পড়তে। তিনি টেলিগ্রামটি পড়ে অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে বললেন যে, আমার বাবার ভয়াবহ ডায়রিয়া/কলেরা হয়েছে এবং দ্রুত লোক পাঠাতে হবে। এই কথা শুনে আমার মা ঘুরে পড়ে যান এবং এতে তাঁর হাত ভেঙে যায়। এই ছিল তখনকার শিক্ষার চিত্র!
আমার বাবা আমাকে হাফেজ বানাতে চেয়েছিলেন। মা চেয়েছিলেন আমি সাধারণ স্কুলে পড়ি। আমার মা ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা নারী, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না পেলেও অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। তাঁর কারণে আমি উত্তরদা জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হই এবং যথারীতি পড়াশোনায় এগিয়ে যেতে থাকি। স্কুলের পরিবেশ ছিল আনন্দময়। শিক্ষকরা ছিলেন ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত নিবেদিত। অনেক সময় শিক্ষকরা ভালো ছাত্রদের নিজের বাড়িতে রেখে পড়াতেন। এখনকার মতো অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট পড়ানোর রীতি তখন ছিল না। গ্রামের স্কুলের তখনকার শিক্ষার মান শহরের শিক্ষার মান থেকে খারাপ ছিল না। বস্তুত তখন গ্রামের ছেলেরাই পাবলিক পরীক্ষায় শীর্ষস্থানে থাকত। মেয়েরা তখন বহুলাংশে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত ছিল। তখন স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হতো ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বদান্যতার কারণে এবং স্থানীয় বিদ্যুৎসাহীরা এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আমার জন্ম লাকসামে, যেখানে শত বছর ধরে যানবাহন এবং মানুষের যাতায়াতের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। মানুষ মূলত হেঁটে চলাফেরা করত, কিছু ভাগ্যবান মানুষ সাইকেল চালাত। পণ্য পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ি ব্যবহার হতো। ওই সময় কুমিল্লা এবং নোয়াখালীর মধ্যে যাতায়াতের প্রধান সড়কেও কোনো মোটরযান ছিল না, এমনকি রিকশাও ছিল না। বর্ষাকালে রাস্তাগুলো পানিতে ভাসতে থাকত, তখন নৌকা দিয়ে স্কুলে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই সময়, বিশেষত বর্ষার দিনে পুরুষেরা একত্র হয়ে পুঁথি পড়ত। তখন শিশুরা খড় দিয়ে বল তৈরি করে ফুটবল খেলত। হাডুডু খেলা ছিল তখন অত্যন্ত জনপ্রিয়।
১৯৫৮ সালে আমাকে লাকসাম হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। প্রতিদিন সাত কিলোমিটার হাঁটতে হতো স্কুলে যাওয়ার জন্য। পড়াশোনার পাশাপাশি আমি পরিবারের জন্য কৃষিকাজ করতাম। ১৬ বছর বয়সে আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন–আমি তখন সবে মেট্রিক পাস করেছি। কিন্তু মায়ের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। মা মনে করতেন পড়াশোনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে, যদিও তার জন্য আর্থিক সংগতি আমাদের ছিল না। বস্তুত এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে মেট্রিক পরীক্ষার ফি আমাকে জমা দিতে হয়েছিল। এসব প্রতিকূলতা আমাকে আরও শক্তিশালী করেছে এবং জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে সহায়তা করেছে।
ছেটবেলা থেকেই আমার রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি হয়। গ্রামের একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে আমার বাবা পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। একবার তিনি আমাকে তখনকার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বক্তৃতা শোনাতে নিয়ে যান। মানুষের ভিড়ে সেখানে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। মানুষের ভিড়ে আমার বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর আমি পাশের বাড়ির এক চাচার দেখা পাই এবং তাঁর সাথে বাড়ি ফিরে আসি।
আমি স্কুলে পড়ার সময় প্রতিদিন টিফিনের বিরতিতে লাকসাম বাজারে গিয়ে ঔষধের ফার্মেসিতে খবরের কাগজ পড়ার জন্য লাইন ধরতাম। কোনোদিন পড়ার সুযোগ হতো আবার কোনোদিন তা হতো না। তখন ইত্তেফাকই ছিল একমাত্র খবেরর কাগজ, তাও আবার আসত এক দিন পরে। স্কুলে পড়ার সময়ই খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস আমাকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলে। আমি জানতে পারি, পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শোষণ করছে। আফ্রিকায় গৃহযুদ্ধ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলেছে ইত্যাদি। এমন রাজনৈতিক সচেতনতার কারণেই ১৯৬২ সালে, ১৬ বছর বয়সে, আমি শিক্ষা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যাই। এভাবেই ছাত্র রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি হয়। ষাটের দশকে আমি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি।
১৯৬২ সালে মেট্রিক (এসএসসি) পরীক্ষায় পাস করার পর (যাতে অংশ নিতে আমাকে বাড়ি থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে কুমিল্লা শহরে যেতে হয়েছিল) আমি লাকসামের নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজে ভর্তি হই। এটি ছিল আমার বাবার প্রথম নিয়োগকর্তার প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজ। এখানে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা যেত। কলেজ জীবনের এই দুই বছরে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে আমি আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ি। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) নির্বাচিত হই। এ সময়ে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠি।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে আমি এক অভিনব অভিজ্ঞতা অর্জন করি। আমার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল আমারই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নির্বাচনের সময় বন্ধু আমার বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক একটি লিফলেট ছাপে। এমন আক্রমণের বিপরীতে আমি তিনটি হাতে লেখা পোস্টার প্রতিষ্ঠানটির তিনটি প্রবেশমুখে সেঁটে দিই। পোস্টারে লেখা ছিল রবীন্দ্রনাথের দুটি কবিতার লাইন: ‘সুজন সুযশ গায় কুযশ ঢাকিয়া, কুজন কুরব করে সুরভ নাশিয়া’। এতেই কেল্লাফতে হয় যায়। আমি বিপুল ভোটে জয়লাভ করি। উল্লেখ্য, আমাদের বন্ধুত্ব এখনও টিকে আছে। ১৯৬৪ সালে আমার বাবা মারা যান, আমার এইচএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে। তাঁর মৃত্যু আমার জীবনে এক অপ্রত্যাশিত ধাক্কা ছিল, যদিও তিনি অনেক দিন থেকেই অসুস্থ ও শয্যাশায়ী ছিলেন। বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পরেই সাইকেল থেকে পড়ে আমার হাত ভেঙে যায়। এসব প্রতিকূলতার মধ্যেই আমাকে পরীক্ষা দিতে হলো। বাবার মৃত্যুর পর আমি বুঝতে পারলাম এখন থেকে মায়ের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব আমার ওপর। এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করে মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে আমি ঢাকায় চলে যাই, ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন আমার হাতে ছিল মাত্র চার আনা পয়সা এবং একটি সরকারি বৃত্তি। ঢাকা শহর আমার জন্য এক অচেনা, বিশাল এবং ভীতিকর স্থান ছিল। এখানে আমার থাকার জায়গা ছিল না, তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার পূর্বপরিচিত এক ছাত্রনেতা আমাকে কিছুদিন আশ্রয় দেন। পরে আমি ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল) স্থায়ী সিট পাই এবং ডাইনিং রুমের বয়দের নাইট স্কুলে পড়ানোর বিনিময়ে হলে আমার খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। একই সাথে আমি গৃহশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করি, যার আয় থেকে আমি আমার মায়ের ভরণ-পোষণের ব্যয় নির্বাহ করি। আমি বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মোহন মিয়ার দুই ছেলের গৃহশিক্ষক ছিলাম।
গ্রাম্য পরিবেশ থেকে আসার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিকে আমাকে খাপ খাইয়ে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের অনমনীয়তা এবং সংকল্পের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে নিজের জায়গা করে নিই। বস্তুত, ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তাল সময়ে আমি নেতৃত্ব প্রদর্শনের সুযোগ পাই। আমি ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করি। ১৯৫৬-৬৬ সালে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে আমি ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হই। পরের বছর আমি হলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। তোফায়েল আহমেদ–যিনি ডাকসুর ভিপি হন–এবং আমি একই প্যানেলে নির্বাচিত হই। এ সময় আমি সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি এবং নিউক্লিয়াসে যুক্ত হই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সময়টা ছিল অনেক কঠিন ও বিপজ্জনক। ষাটের দশকে তিনটি বড় ছাত্র সংগঠন ছিল–ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ)। এনএসএফ ছিল ক্ষমতাসীন আইয়ুব-মোনেম খানের মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন। রাজনীতির উত্তাল সময়ে আমি একাধিকবার এনএসএফের গুন্ডাদের আক্রমণের শিকার হই। খোকা, পাঁচপাত্তু ও জামির আলী নামে এনএসএফের গুন্ডারা হকিস্টিক এবং ছুরি দিয়ে অন্য সংগঠনের ছাত্রদের ওপর তখন হামলা করত। একবার এনএসএফের আক্রমণের মুখে আমি হলের মসজিদের ছাদ থেকে বিদ্যুৎ বাতির হ্যান্ডেল ধরে লাফিয়ে পড়ে পায়ের গোড়ালি ভেঙে ফেলি, যদিও বিদ্যুৎস্পর্শে আমি মারা যেতে পারতাম। এরপর একদিন এনএসএফের আক্রমণের সময় তারা আমার ওপর এসিড ছুড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু এক বড় ভাইয়ের উপস্থিত বুদ্ধি আমাকে বাঁচিয়ে দেয়।
তবে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময়ে এগারো দফার ভিত্তিতে সব ছাত্র সংগঠন একত্রে কাজ করেছিল। এগারো দফার মধ্যে আওয়ামী লীগের ছয় দফাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল ইকবাল হল থেকে। হল সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সেই আন্দোলনে আমারও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সে সময়ে আমার ঘনিষ্ঠ সহচর ছিল এটিএম জাফর আলম ও চিশতী হেলালুর রহমান। তারা দু’জন আমার কেবিনেটের যথাক্রমে সাহিত্য ও কমনরুম সম্পাদক ছিল। তারা দু’জনই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে শহীদ হয়। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার জাতীয় সংহতি জোরদার করার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তখনকার রোকেয়া হলের প্রভোস্ট প্রফেসর আখতার ইমামের নেতৃত্বে একটি ডেলিগেশন পশ্চিম পাকিস্তান সফরে পাঠায়। ডেলিগেশনে প্রত্যেক হল থেকে একজন ছাত্র/ছাত্রী ছিল। আমি ছিলাম ইকবাল হলের প্রতিনিধি। ডেলিগেশনে অন্য যারা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম মঈন খান, বদিউর রহমান, মোহাম্মদ মাসুম প্রমুখ। প্রফেসর ইমাম ছাত্রীদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর হলেও ছেলেদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত উদার ও স্নেহপ্রবণ।
আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পরিদর্শন করি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিই। আমার মনে আছে, লাহোরে গভর্নমেন্ট কলেজ হোস্টেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। আমরা হোস্টেলে প্রবেশের সময়ে রুমের একটি বাল্ব ফুটে যায়। প্রফেসর ইমাম সাথে সাথেই আপত্তি তোলেন যে আমার ছেলেরা এখানে থাকবে না। ফলে বিলাসবহুল ইস্ট পাকিস্তান হাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সরকারের ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত এএমএ মুহিত এর আয়োজন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত অনেক কর্মকর্তার স্ত্রী প্রফেসর ইমামের ছাত্রী ছিলেন, তাই সেখানেও তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ও গুণগ্রাহী ছিলেন। তাই অনেক বাঙালি কর্মকর্তার বাসায় আমাদের দাওয়াত খাওয়ার সুযোগ হয়। সিভিল সার্ভিস একাডেমিতেও তখন আমাদের যাওয়া হয়। খাইবার পাস যাওয়ার আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল অনন্য। সেখানে যাওয়ার পথে আমরা লান্ডি কোটাল যাই, যাকে পৃথিবীর ‘গ্যাব্লিং ক্যাপিটাল’ বললে অত্যুক্তি হবে না–পৃথিবীর এমন কিছু নেই, যা সেখানে পাওয়া যেত না। আমার মনে আছে, সেখান থেকে আমি সুইজারল্যান্ডে তৈরি ফেবারলুবা ব্যান্ডের একটি ঘড়ি কিনি, যা বহু বছর ধরে আমি ব্যবহার করেছি। সেখানকার সব পুরুষকেই একটি বন্দুক কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে আমরা দেখি। সিন্ধুতে আমরা সিন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থান করি। সেখানে ভুল করে আমি একটি জামা ফেলে আসি, যা আমি আমার বন্ধু নাজমুল থেকে ধার করে নিয়ে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য সে জামাটি আমাকে ফেরত পাঠানো হয়, যা আমাকে বিস্মিত করেছে।
১৯৬৮ সালে মাস্টার্স পরীক্ষার আগেই আমি কায়েদে আযম কলেজে লেকচারার হিসেবে চাকরি নেই। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করি। ছাত্র হিসেবে প্রফেসর হাবিবুল্লাহর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং আমি তাঁকে কয়েকটি বই লেখার কাজে সহায়তা করি। শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর আমরা দু’জন কমার্স বিভাগকে বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে পরিণত করার উদ্যোগ নিই। তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর আবদুল্লাহ ফারুক এর বিরোধিতা করেন। বিষয়টি বেশ জটিল আকার ধারণ করে। সেই জটিল পরিস্থিতিতে প্রফেসর হাবিবউল্লাহ হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা সফল হই এবং কমার্স বিভাগ বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে পরিণত হয়।
সারা পাকিস্তানে এক প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ১৯৭০ সালে আমাকে রোটারি ফাউন্ডেশন গ্র্যাজুয়েট ফেলোশিপ দেওয়া হয়, যা আমাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু অতীতে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারণে পাকিস্তান সরকার আমাকে পাসপোর্ট দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীর সহায়তায়, যিনি নিজে একজন রোটারিয়ান ছিলেন, আমি শেষ পর্যন্ত পাসপোর্ট পেতে সক্ষম হই। ফেলাশিপটির উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রীতির বিস্তার ঘটানো, ডিগ্রি অর্জন করা নয়। তবুও আমি একটি মাস্টার ডিগ্রি অর্জনে বদ্ধপরিকর ছিলাম এবং সেই প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিলাম। ফলে ৯ মাসে ক্ল্যারমন্ট গ্র্যাজুয়েট স্কুল থেকে একটি মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করি, যার জন্য বড়দিনের ছুটিতে আমাকে থিসিস লেখাটি সম্পন্ন করতে হয়। এমন একটি ডিগ্রি অর্জন করতে সাধারণত দেড় থেকে দুই বছর সময় লাগে। ক্ল্যারমন্ট গ্র্যাজুয়েট স্কুলে পড়ার সময়ে আমি পিটার ড্রাকারকে শিক্ষক হিসেবে পাই। তিনি ছিলেন আধুনিক ম্যানেজমেন্টের জনক এবং বিশ্ববিখ্যাত। তাঁর কাজের ওপরই বহু গ্রন্থ লিখেছেন অন্যরা। ছাত্র হিসেবে আমি তাঁর ব্যাপক আস্থা অর্জন করি। আমি যখন তাঁর ক্লাস করি তখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই সময় তিনি আমাকে তাঁর কাছে টেনে নেন। অনেকটা গডফাদারের ভূমিকা পালন করেন। আমি তখন দেশে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার উপায় খুঁজছিলাম। তিনি আমাকে তা করতে বারণ করেন। তিনি আমাকে ধৈর্য ধরতে বলেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আমার প্রয়োজন হবে। প্রফেসর ড্রাকার অনেকটা জোর করেই আমাকে তখন দেশে ফেরা থেকে বিরত রাখেন।
কায়েদে আযম কলেজে শিক্ষকতাকালীন মাহবুবুন্নেসা নামে একজন শিক্ষিকার সাথে আমার পরিচয় ঘটে। পরে আমাদের সম্পর্ক গভীর হয় এবং ১৯৭০ সালে আমরা বিয়ে করি। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকার বনগ্রাম রোডের একটি বাড়িতে আমরা থাকতাম। বনগ্রাম রোড ছিল একটি বিহারি অধ্যুষিত এলাকা। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়িগুলো বিহারিদের বরাদ্দ দেওয়া হয়।
আমেরিকা যাওয়ার জন্য আমার পাসপোর্ট, মার্কিন ভিসা সংগ্রহ করতে বেশ সময় লেগে যায়। রোটারি গভর্নর আবদুর রহিম খান আমাকে এ ব্যাপারে সহায়তা করেন। পাকিস্তান আমলে ফরেন কারেন্সির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল, ফলে পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক থেকে আমাকে মাত্র ১০ ডলার দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে রওনা দেওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি দারুণভাবে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। কারণ আমার স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। একমাত্র সন্তান হিসেবে আমি আমার মাকে রেখে যেতেও দ্বিধান্বিত ছিলাম। তবে আমার মা ও স্ত্রী উভয়েই আমাকে আমেরিকায় যেতে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। আমার ফেলোশিপটি ছিল মাত্র ৯ মাসের, তাই বছর পার হওয়ার আগেই দেশে ফিরে আবার মা, স্ত্রী এবং সন্তানের সঙ্গে মিলিত হতে পারব–এই চিন্তা থেকে আমি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন অবশ্য কল্পনার মধ্যেই ছিল না যে দেশে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ হবে এবং আমি বিদেশে আটকা পড়ে যাব।
ক্ল্যারমন্ট থেকে মাস্টার্স শেষ করার পর আমি পিএইচডি অর্জনের জন্য কেইস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। আমার পিএইচডি ছিল অর্থনীতির ওপর। বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। আমি মাত্র ৩১ বছর বয়সেই পিএইচডি সম্পন্ন করি। পিএইচডি করার সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে আমি গবেষণা করেছি। প্রযুক্তির পরিবর্তন কীভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে সেটার ওপরে ছিল আমার গবেষণা। সেটার ওপর আমি থিসিস লিখেছি। আমার থিসিসটি গবেষকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছিল।
১৯৭৬ সালে আমার পিএইচডি শেষ হয়। এই সময়টায় আর দেশেও আসা হয়নি। এরপর ১৯৭৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে ক্লিভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটি, সিয়াটল ইউনিভার্সিটি এবং ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করি। আমি অর্থনীতি ও ফিন্যান্স পড়াতাম। অধ্যাপনা করতে করতে আমি পূর্ণ অধ্যাপক পর্যন্ত হই। আমার বেশ কিছু গবেষণাকর্ম এখনও অন্য গবেষকদের কাছে সমাদৃত। আশির দশকে নাসার মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গেও কাজ করেছি। দেশে ফিরে এসে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিতে পারলেও বিদেশে বসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানাভাবে আমি ভূমিকা রেখেছি। ক্লিভল্যান্ডে পড়ার সময় ‘বেঙ্গল রিলিফ গ্রুপ’ নামে একটা সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। আমি ছিলাম ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। আমরা এ সংগঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লবি করেছিলাম, অর্থকড়ি সংগ্রহ করেছিলাম এবং বিভিন্নভাবে জনমত সৃষ্টি করেছিলাম।
১৯৮৩ সালে আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। সেই বছর এক গাড়ি দুর্ঘটনায় আমার স্ত্রী মাহাবুবুন্নেসার প্রাণহানি ঘটে। এটি ছিল দুটি গাড়ির সামনাসামনি সংঘর্ষের দুর্ঘটনা। আমিই গাড়িটি চালাচ্ছিলাম। আমার বুকে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের ধাক্কায় পাঁজরের বেশ কয়েকটি হাড় ভেঙে যায়। আমার মাথা গিয়ে সামনের উন্ডশিলে ধাক্কা দেয় এবং কাঁচ ভেঙে ফেলে। আমার স্ত্রী পাশের সিটে বসা ছিলেন এবং তিনি মাথায় ভয়ানক অঘাত পান। আমরা উভয়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। দুর্ঘটনাটি ঘটে রিইনিয়ার পর্বতের কাছে। আমাদের দু’জনকে মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও আমার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরে আসেনি। তিনি তিন সন্তান–যাদের বয়স ছিল যথাক্রমে এগারো, পাঁচ এবং তিন বছর–এবং আমাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান, যদিও যে ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছিল, তাতে আমারই মৃত্যু হওয়ার কথা। নিঃসন্দেহ আমি একজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি।
অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধ্যাপনা ছেড়ে আমার মাতৃঋণ শোধ করার লক্ষ্যে আমি ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসি। গত প্রায় ৩৪ বছর আমি সক্রিয় রয়েছি বাংলাদেশে ক্ষুধামুক্তি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। জনবান্ধব আইন ও নীতি প্রণয়ন এবং শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, আমি বহু মানুষের জীবনকে স্পর্শ করেছি, বহু মানুষের স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েছি।
আমি চাই যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হোক। আগামীর বাংলাদেশ হোক সুখী-সমৃদ্ধ ও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে মানুষ ধর্ম, বর্ণ ও রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে বৈষম্যের শিকার হবে না। সবাই সমসুযোগ পাবে। সবার জন্য পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ থাকবে।